শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

প্রয়োজন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন | প্রকাশের সময় : ১৯ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

পৃথিবীর যে কোন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জনগণ সর্বাধিক নির্বাচনমুখী। গণতন্ত্রের জন্য এ অঞ্চলের মানুষ যে ত্যাগ, সংগ্রাম করেছে উপমাহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তার নজির নেই। কিন্তু সে গণতন্ত্র আজ শৃঙ্খলিত। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও মানবিক মূল্যবোধ তথা পরমসহিষ্ণুতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি বাংলাদেশে। সহমর্মিতা-সহানুভূতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা গণতন্ত্রের মূল খুঁটি হলেও তা নির্বাসিত। একটি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই। দেশে গণতন্ত্রের যে শনির দশা চলছে, তা দূরীভূত করতে না পারলে অশান্তির আগুন নিভবে না। উন্নয়নশীল দেশের সাথে পাল্লা দিয়ে যদি বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হতে হয়, তাহলে অবশ্যই সবার আগে উন্নত গণতন্ত্র তথা সুষ্ঠু ও কার্যকর গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে। গণতন্ত্রের অর্থ এই নয় যে, মেয়াদ শেষে নিছক একটি নির্বাচন। তবে একটি দেশের উন্নয়ন তথা শান্তির জন্য একটি অংশগ্রহণমূলক অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত।
এই সরকারের শাসনামলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, নির্বাচনী ব্যবস্থা একরকম ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তবে নির্বাচনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশনই কার্যত নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে ক্ষমতাসীন দলের অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চরিত্র ততই জাতির সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসের ৯০ দিন আগে তথা ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলের নেতা নেত্রীরা যে ভাষায় কথা বলছেন তাতে স্ষ্ঠুু নির্বাচনের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আমরা এখনো নির্লোভ শাসক খুঁজে পায়নি। যারাই ক্ষমতার বাইরে থাকেন তারা গণতন্ত্রের জন্য মায়া কান্না করেন। কিন্তু তারাই যখন ক্ষমতায় আসীন হন তখন গণতন্ত্রের বারোটা বাজাতে দ্বিধাবোধ করেন না। একটা সময় তো বাংলাদেশের মানুষ ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছে। পাকিস্তানের শাসকদের কাছ থেকে আমরা ১৯৭০ এর নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায় করে নিয়েছিলাম। আবার ৯০’র গণআন্দোলনে এরশাদশাহীর পতনের মাধ্যমে হৃত গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলাম। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমাদের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র দুইই গভীর খাদে পতিত হয়েছে। এরপর স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা পেশীশক্তির জোরে জয়ী হয়েছে। ভোট এখন পরিণত হয়েছে নিছক আনুষ্ঠানিকতায়। বেশিরভাগ কাজ আগেই হয়ে যাচ্ছে। ভোটের দিন ভোটররা কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের হয়ে অন্যরা ভোট দিয়ে দিচ্ছে। যারা একটু প্রতিবাদী হওয়ার চেষ্টা করছে তাদেরই উপর নির্মম নির্যাতনের নিষ্ঠুরতা প্রয়োগ করা হয়েছে। আওয়ামী সরকারের অধীনে স্ষ্ঠুু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমনটি আশা করা দুরাশা ব্যতীত আর কিছুই না।
ক্ষমতার অপব্যবহারেরই নাম দস্যুবৃত্তি। ক্ষমতার অপব্যবহার মানবকে দানবে পরিণত করে। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হলে জাতির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে যেতে হয়। ইতিহাস সাক্ষী, যারাই ক্ষমতার মত্তে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়েছে তাদেরই এক সময় না এক সময় মাশুল দিতে হয়েছে। মহাযুদ্ধের সময় আমরা জাপানকে জ্বলে পুড়ে ছারখার হতে দেখেছি। জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহরে আমেরিকা লিটল বয় ও ফ্যাটম্যান নামে যে আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল তার মাশুল আজও জাপানীরা দিচ্ছে। এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নও বিশ্বব্যাপী দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। কিন্তু বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন নানা খÐে বিভক্ত হয়ে এখন নিজের অস্তিত্ব রক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। আসলে প্রত্যেক ক্রিয়ারই যে একটা সমমাত্রিক বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে এটা ক্ষমতাসীনরা ভুলে যান। আগামী নির্বাচন হয়তো আওয়ামী সরকারের পরিকল্পনা মাফিক অনুষ্ঠিত হবে। তারা আবার ক্ষমতায়ও আসতে পারে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন থেকে ইউপি নির্বাচন পর্যন্ত মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের পূর্বশর্ত ভোটাধিকারের যে চিত্র একের পর এক উঠে এসেছে তাতে প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক, আওয়ামী লীগ তো আর চিরকাল ক্ষমতায় থাকবে না। তাহলে যখন দলটি বিরোধী দলে যাবে তখন তৃণমূল বিস্তৃত সাংগঠনিক কাঠামোতে সহিংসতার ক্ষতের দায়ভার কে নেবে। ভারতে প্রাচীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেসকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিধিবিধান ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথেই হাঁটতে হয়েছে। দশ বছরের শাসনামল শেষে বিগত লোকসভা নির্বাচনে দলটির চরম ভরাডুবি ঘটলেও রাজনীতির পথেই মানুষের মাঝে গিয়েই রাজনীতি করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে যে যাবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে, আর ভবিষ্যতে বিরোধী দলে গেলে তারা যে জ্বালাও পোড়া করবে না তারই বা কী গ্যারান্টি আছে? দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতার লড়াই মূলত আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপির মধ্যে চলছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অবস্থা হচ্ছে ডিঙ্গি নৌকার মতো। যেমনটি সমুদ্রে বড় জাহাজের সাথে ছোট ডিঙ্গি নৌকা বাঁধা থাকে। এই দুই দলের সাথেও দু’একটি দল ছাড়া বাকি সবই ডিঙ্গি নৌকা। অন্যদিকে বর্তমান সংসদের বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টির কার্যক্রমে বিরোধী দলের যে ভূমিকা তাঁরা পালন করছে তা দূরবীণ দিয়েও খুঁজে পাওয়া ভার। দলটিকে অনেকে এখন জ্বী হুজুর বলে থাকেন। ক্ষমতাসীন শাসক গোষ্ঠী যা বলে তাতেই জ্বী জ্বী করে সায় দেয়। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগ্রেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এর ভাষ্যমতে, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কিনা সংশয় রয়েছে। দ্য ইকোনমিস্ট লিখেছে, আগামী ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন। এর এক সপ্তাহ পরেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় দিয়ে তাকে জেলে নেয়ায় এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আসন্ন নির্বাচনেও শেখ হাসিনার পরাজয়ের কোনো ইচ্ছা নেই। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, ঢাকায় বেশ জোরে গুঞ্জন আছে যে, এই মুর্হুতে যদি বাংলাদেশে নির্বাচন হয়, শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ শোচনীয়ভাবে হেরে যাবে। গণতন্ত্রের সবচাইতে সুন্দর দিক হলো সুষ্ঠু ও অবাধ নিরপেক্ষ একটা নির্বাচন জাতিকে উপহার দেয়া। সূর্য অপরিমেয় শক্তির উৎস। অগ্নিতাপে পৃথিবীকে ভস্মীভূত করতে পারে। কিন্তু সে ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে স্তিমিত করে যাতে জীব-জন্তু, পশু-পক্ষী, কীটপতঙ্গ, বৃক্ষলতা সকলেই জীবন ধারণ করতে পারে। ক্ষমতায় কেউ চিরদিন থাকে না। আর চিরদিন কারও সমান যায় না। দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশা সরকার জনগণের মনের দ্রোহটা অনুধাবন করে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন