শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

প্রতিটি হত্যাকান্ডই নিন্দনীয়

প্রকাশের সময় : ৯ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গত বুধবার রাত ৯টার দিকে সূত্রাপুরের একরামপুর মোড়ে দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সের স্নাতকোত্তার শ্রেণীর ছাত্র নাজিম উদ্দিন সামাদকে। তাকে কারা এবং কেন খুন করেছে, তা পুলিশ এখনও জানতে পারেনি। তবে ধারণা করা হচ্ছে ফেসবুকে জঙ্গিবাদ, ধর্মান্ধতা নিয়ে লেখালেখির কারণে উগ্রবাদী গোষ্ঠী তাকে হত্যা করতে পারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও এমন আশঙ্কা করেছেন। সামাদ হত্যাকা-ের নিন্দা জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। তারা ঘটনা তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রবার্ট ওয়াটকিনস এক বিবৃতিতে বলেছেন, অনলাইন এক্টিভিস্ট হত্যায় সম্প্রতি ছেদ পড়লেও এই হামলায় প্রতীয়মান হচ্ছে, বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। তিনি ঝুঁকির মুখে থাকা অনলাইন এক্টিভিস্টদের ‘পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত’ করতে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, একের পর এক ব্লগার, অনলাইন এক্টিভিস্ট খুন হওয়া এবং সেগুলোর কোনো সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করতে না পারায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। শুধু অনলাইন এক্টিভিস্টই নয়, মসজিদের মুয়াজ্জিন ও ইমাম থেকে শুরু করে পীর-মাশায়েখও খুনের শিকার হচ্ছে। এসবেরও কোনো সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করা হচ্ছে না।
আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, মুক্তমনা বলে পরিচিত ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট খুন হলে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ প্রভাবশালী সংস্থাগুলো দ্রুত তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। অন্যদিকে মসজিদের ভেতরে মুয়াজ্জিন, ইমাম এবং বাসাবাড়িতে পীর-মাশায়েখ খুন হলে তা নিয়ে তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। কোনো ধরনের টুঁ শব্দও তারা করে না। তাদের নীরবতায় এটাই প্রতীয়মান হয়, মুসলমান খুন হওয়া তাদের দৃষ্টিতে তেমন কিছু নয়। মুসলমানদের জীবন কোনো জীবন নয় এবং তাদের মানবাধিকার বলেও কিছু থাকতে নেই। জাতিসংঘের মতো একটি বিশ্বসংস্থা যদি এমন একচোখা নীতি অবলম্বন করে, তবে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের ও দুঃখজনক। আন্তর্জাতিক মহলের কথা বাদই দেয়া যাক, আমাদের দেশের তথাকথিত প্রগতিবাদী এবং তাদের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা যায় না। তাদের নিশ্চুপ থাকা থেকেও মনে হয়, তাদের কাছে ইমাম, মুয়াজ্জিন, পীর-মাশায়েখের মানবাধিকার ও জীবনের কোনো মূল্য নেই। তারা যেন মানবাধিকার বলতে একশ্রেণীর ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টদের অধিকারকেই বোঝে। তারা এটা বুঝতে চাই না, মানুষ তা সে যে ধর্ম ও সম্প্রদায়েরই হোক, বা যে কর্মেই নিয়োজিত থাক তার জীবনহানি করা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। প্রত্যেক মানুষের  জীবন অমূল্য। আমরা বহুদিন ধরে লক্ষ্য করে আসছি, আমাদের দেশে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা নিয়ে প্রগতিবাদীরা যতবেশি সরব ও সোচ্চার হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের উপর নিপীড়ন, নির্যাতন ও খুন নিয়ে তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। এমনকি সংখ্যালঘুদের উপর একটু ফুলের টোকাও তারা সহ্য করে না। সঙ্গে সঙ্গে হায় হায় করে উঠে। আমরা বলতে চাইছি, সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠ যে সম্প্রদায়ের মানুষই হোক না কেন, হামলা ও খুনের শিকার হলে প্রত্যেকের ব্যাপারেই সচেতন গোষ্ঠীর সরব হওয়া উচিত। আমরা প্রত্যেকেই জানি, রক্ত কেবল রক্ত বয়ে আনে, ঘৃণা শুধু ঘৃণা আহ্বান করে। এ পর্যন্ত যত ব্লগার, অনলাইন এক্টিভিস্ট, ইমাম, মুয়াজ্জিন, পীর-মাশায়েখসহ সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হামলা ও খুনের শিকার হয়েছে, এসব ঘটনার সাথে সম্পৃক্তদের যদি গ্রেফতার করে উপযুক্ত শাস্তি বিধান করা হতো, তাহলে এই রক্ত ও ঘৃণার রাস টেনে ধরা যেত। এসব বিশেষায়িত ঘটনার একটিরও কোনো সুরাহা না হওয়ায়, ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত গোষ্ঠী প্রশ্রয় পেয়ে যে একের পর এক ঘটনা ঘটাচ্ছে, ধারাবাহিক এসব হত্যাকা- থেকে তাই বোঝা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু হয়ে উঠেছে। অথচ সবাই জানেন, যত জটিল ও রহস্যপূর্ণ ঘটনা হোক না কেন আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা উদঘাটন করতে সক্ষম। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে তারা কেন এসব ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটন ও হোতাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হচ্ছে না?
কোনো হত্যাকান্ডকেই আলাদাভাবে দেখার সুযোগ নেই। প্রত্যেক হত্যাকা-ই নিন্দনীয়। দেশী-বিদেশী প্রত্যেক সংস্থা ও সংগঠনকে মানবাধিকার প্রশ্নে সব হত্যাকান্ডেরই নিন্দা করতে হবে। কোনো বিশেষ শ্রেণীর খুনের ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলা এবং অন্যদের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকা কাম্য হতে পারে না। সকল হত্যাকান্ডকে সমান দৃষ্টিতে দেখতে হবে এবং তার জোরালো প্রতিবাদ করতে হবে। এখানে কে সংখ্যালঘু কে সংখ্যাগুরু কে বিশেষ শ্রেণীর- এ বিবেচনা ও বিভেদ করা যাবে না। প্রত্যেক হত্যাকা-কেই সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। বলা বাহুল্য, ধারাবাহিকভাবে ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ডের কোনোটিরই যথাযথ তদন্ত ও উদঘাটন না হওয়া এবং দোষীদের ধরতে না পারায় হত্যাকান্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। আমরা চাই, ব্লগার, অনলাইন এক্টিভিস্ট, মুয়াজ্জিন, ইমাম, পীর-মাশায়েখসহ সব হত্যাকান্ডের বিচার হোক। এসব হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার ও কঠোর শাস্তির বিধান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা জরুরী। তা না হলে ধারাবাহিক এই হত্যাকা- রোধ করা যাবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন