শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

দাদার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত মুক্তামনি

ইনকিলাব সম্পাদকের প্রতি মুক্তার পরিবারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ

আক্তারুজ্জামান বাচ্চু, সাতক্ষীরা থেকে | প্রকাশের সময় : ২৩ মে, ২০১৮, ৮:৫৯ পিএম | আপডেট : ৯:৩৫ পিএম, ২৩ মে, ২০১৮
বাঁচানো গেল না মুক্তামনিকে। সাদা কাপড় পরে দাদার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলো ১২ বছর বয়সী শিশু মুক্তামনি। আজ যোহর নামাজের পর জানাযা নামাজ শেষে তাকে সমাহিত করা হয় পারিবারিক কবরস্থানে। জানাযা নামাজ পড়ান মুক্তার চাচা কলারোয়া উপজেলার বাটরা মোড়লপাড়া জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ ক্বারী মোঃ মনিরুজ্জামান।  সাতক্ষীরা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোঃ আসাদুজ্জামান বাবু, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আর এম ও) ডাঃ মোঃ ফরহাদ জামিল, সিভিল সার্জন অফিসের প্রধান সহকারি আশেক নওয়াজ, হাওয়ালখালি পূর্বপাড়া জামে মসজিদের ইমাম  মাওলানা নূরুজ্জামান, দক্ষিণ কামারবায়সা জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল খালেক, মাওলানা মোঃ আদম শফিউল্লাহসহ সাংবাদিক, এলাকাবাসী ও মুক্তার নিকট আত্মীয়রা জানাযা নামাজে অংশগ্রহণ করেন। 
রক্ত নালীর টিউমারে আক্রান্ত মুক্তামনি আজ বুধবার সকাল সোয়া ৮ টার দিকে সাতক্ষীরা সদরের বাঁশদহা ইউনিয়নের কামারবায়সা গ্রামের নিজ বাড়িতে  মারা যায়। সে মোঃ ইব্রাহিম গাজীর মেয়ে।
দেড় বছর বয়স থেকে মুক্তামনি’র ডান হাত ফুলে যাওয়া ও ব্যথা যন্ত্রনা’র লক্ষণ দেখা দেয়। এরপর সাতক্ষীরা, খুলনা ও ঢাকায় চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু কোন উপকার না হয়ে দিনে দিনে মুক্তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ডান হাতটি আরো ফুলে গিয়েছিলো। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় মুক্তার অসুখের বিষয়টি উঠে আসলে অনেকেই মুক্তার চিকিৎসায় হাত বাড়ান। পরে মুক্তামনির চিকিৎসার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  ২০১৭ সালের ১২ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয় মুক্তামনিকে। প্রথমে তার রোগটিকে বিরল রোগ হিসেবে উল্লেখ করেন চিকিৎসকরা। পরে বায়োপসি করে চিকিৎসক জানতে পারেন তার রক্তনালীতে টিউমার হয়েছে। তখন তার উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালের ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করেন বার্ন ইউনিটের ডাক্তাররা। ভিডিও কনফারেন্স’র মাধ্যমে মুক্তামনির সব রিপোর্ট দেখে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরা তার চিকিৎসা করতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর ঢামেক হাসপাতালেই তার অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকরা। ৫ আগষ্ট প্রথম অ¯ো¿াপচার করা হয় মুক্তা মনির ডান হাতে। হাতের ফোলা অংশে অস্ত্রোপচার করে তা ফেলে দেওয়া হয়। পরে আরো দুই দফায় অস্ত্রোপচার করে মুক্তার দুই পায়ের চামড়া নিয়ে হাতে লাগানো হয়।
ঢামেকের বার্ণ এন্ড প্লাষ্টিক সার্জারি ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালামের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের একটি দল মুক্তামনির স্কিন গ্রাফটিং (চামড়া লাগানো) অপারেশনে অংশ নেন। এর কিছুদিন পর আবারো মুক্তামনির হাত ফুলে যায়। তখন ফোলা কমানোর জন্য ডাক্তাররা তার হাতে প্রেসার ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন।  ২২ ডিসেম্বর ঢাকা  মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট থেকে মুক্তাকে তার গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। সেখান থেকেই মুক্তা বাড়িতে ছিলো। দিনে দিনে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। অপারেশন করে হাত থেকে যা কিছু অপসারণ করা হয়েছিল তা আবারো পুরণ হয়ে যায়। এবং তার ডান হাত দূর্গন্ধযুক্ত হয় ও  নিয়মিত রক্ত ঝরতে শুরু করে।  এমনকি হাত থেকে বড় বড় পোকাও বের হতে থাকে।
মুক্তা মনির পিতা মোঃ ইব্রাহিম গাজী ও মা আসমা খাতুন জানান, গত কয়েকদিন ধরে মুক্তামনি জ্বরে ভুগছিলো। মঙ্গলবার রাতে তার শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটে। বুধবার সকালে মুক্তা পানি খেতে চায়। পানি পান করার পর পরই মুক্তা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
ডাক্তার হতে চেয়েছিলো মুক্তামনি : মাত্র দেড় বছর বয়সে মুক্তামনি’র ডান হাতে ফোলা ও যন্ত্রনা শুরু হলে তাকে পর্যায়ক্রমে সাতক্ষীরার কয়েকজন ডাক্তারকে দেখানো হয়। এরপর খুলনা ও ঢাকা পিজি হাসপাতালে তাকে চিকিৎসা করান তার পিতা ইব্রাহিম গাজী। কিন্তু কোন উন্নতি না হওয়া এবং তার অসুখটি ডাক্তাররা নির্ণয় করতে না পারা, সর্বশেষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কয়েকদফা অপারেশন করে সুফল না পাওয়ায় ভারাক্রান্ত্র মনে বাড়িতে শুয়ে থেকে মুক্তামনি পরিবারের সদস্যদের বলতো, আল্লাহ যদি তাকে সুস্থ করেন, তাহলে সে পড়াশুনা করে একজন বড়ো ডাক্তার হবে। কেউ যেনো ভুল চিকিৎসা না পায়, সেজন্য সে সচেষ্ট থাকবে। মুক্তা আফসোস করে বলেছে তাকে প্রথম অবস্থাতেই ডাক্তাররা ভুল চিকিৎসা করেছে। কথাগুলো কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো মুক্তামনি’র জময বোন হীরা মনি। হীরামনি এখন মুক্তামনি’র ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে চায়। এজন্য সে সকলের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করোেছ।
ইনকিলাব সম্পাদকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ : দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক ও জমিয়াতুল মোদার্রেছীন এর সভাপতি এ এম এম বাহাউদ্দীন এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন মুক্তামনি’র পিতা ও মাতা। গত কয়েকদিন ধরে ইনকিলাব সম্পাদক যেভাবে মুক্তামনি’র খোঁজ নিয়েছেন তাতে তিনি মুগ্ধ, কৃতজ্ঞ। তারা  জানান, মুক্তামনি’র বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি। কিন্তু সর্বশেষ চিকিৎসার সকল খরচ নিজ দায়িত্বে নেওয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়ে আবারো ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ইনকিলাব সম্পাদক মহোদয় তার প্রতিনিধি’র মাধ্যমে বারংবার তাকে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু মুক্তামনি রাজী না হওয়ায় ঢাকায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি ইনকিলাব সম্পাদকসহ তার প্রতিনিধিদের র্দীঘায়ু কামনা করেছেন।
মুক্তামনি’র পরিবারের প্রতি ইনকিলাব সম্পাদকের শোক ও সমবেদনা প্রকাশ : মুক্তামনি’র শোক সমÍপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন। তিনি শোকাহত পরিবারের সদস্যদের শোক কাটিয়ে ওঠার জন্য মহান রাব্বুল আল আমিনের কাছে প্রার্থনা করেছেন। একই সাথে মুক্তামনির পরিবারের শোকাহত সদস্যদের কাছে কিছু নগদ অর্থ প্রেরণের ব্যবস্থা করেছেন সম্পাদক মহোদয়।
কাঁদতে কাঁদতে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলো মুক্তার মমতাময়ী মা  : জানাযা নামাজ শেষে যখন মুক্তাকে খাটিয়ায় করে কবরস্থানের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন মুক্ত মুক্তা করে চিৎকার করে কাঁদছিলো মমতাময়ী মা আসমা খাতুন। বারংবার মূর্ছা যাচ্ছেন আবার চিৎকার করে কাঁদছেন। এ দৃশ্য চোখে দেখার মতো নয়। মুক্তা আমার কলিজার ধন। তুই ফিরে আয় মা। হে আল্লাহ তুমি আমার মুক্তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। ওকে জীবিত করে দাও। মমতাময়ী মায়ের এমন আহাজারিতে সেখানকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠেছিলো। সাথে কাঁদছিলো মুক্তার জময বোন হীরামনিও।
 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন