মানুষ কী খাবে? এদেশে নিরাপদ খাবার কী আদৌ আছে? সব খাবারইতো ভেজালে ভরা। ভেজাল খেয়ে খেয়ে গোটা জাতি আজ রোগাক্রন্ত। আমরা হাত বাড়িয়ে যা খাচ্ছি তার সবকিছুতেই তো ভেজাল। উন্নত দেশ ও সমাজে খাদ্যে ভেজাল অকল্পনীয়। অথচ আমাদের দেশে ভেজালমুক্ত খাবার পাওয়া অসম্ভব। ভেজালের মাত্রা দিনদিন কল্পনাকেও যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এতোদিন মাছে ফরমালিন মিশানো হতো। এখন শিশুদের প্রধান খাদ্য দুধেও নির্বিচারে ফরমালিন মিশানো হচ্ছে। দীর্ঘদিন যাবৎ প্রকাশ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশিয়ে পাকানো হচ্ছে আম, কাঠাল ও কলা। আর শুঁটকিতে স্প্রে করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ পরিবারভুক্ত কীটনাশক ডিডিটি। আইসক্রিমসহ লোভনীয় সব মিষ্টি তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে চামড়া ও অন্যান্য শিল্পে ব্যবহৃত বিপজ্জনক রং ও রাসায়নিক। বেকারি পণ্যে মিশানো হচ্ছে গাড়ির পোড়া মবিল, মশলায় ইটের গুঁড়া। আর বাসি ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যসামগ্রীর ছড়াছড়ি তো দেশের সর্বত্রই।
শাকসবজি থেকে শুরু করে ফলমূলসহ নিত্যদিনের সব খাবারেই রয়েছে ভেজাল ও বিষাক্ত রাসায়নিকের ঝুঁকি। পকেটের টাকা খরচ করে যা কেনা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই প্রকৃতপক্ষে বিষ। আর বিষাক্ত এ খাবার গ্রহণের ফলে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে দেশবাসী। বিশেষ করে শিশুরাই এর প্রধান শিকার। চিকিৎসকরা শিশুদের নানা রোগের জন্য ভেজাল ও রাসায়নিকযুক্ত খাবারকেই দায়ী করছেন। অধিক মুনাফার আশায় ব্যবসায়ীরা ক্রেতার হাতে বিষ তুলে দিচ্ছে। হাতেনাতে ধরা পড়ার পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা নিজ মুখেই বলছে রাসায়নিক মেশানোর কথা। শুধু নিজের দায়টুকু স্বীকার করছে না। পাইকারি ব্যবসায়ী দুষছে খুচরা বিক্রেতাকে। আর খুচরা বিক্রেতা বলছেন, আড়ত থেকেই চলছে এসব। ভেজাল রোধে সরকারি-বেসরকারি নানা চেষ্টা সত্তে¡ও চলছেই এ কারবার। মাছে মিলছে বিষাক্ত ফরমালিন, ফলে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথেফেন, প্রোফাইল প্যারা টিটিনিয়াম (পিপিটি) পাউডার, বিস্কুটসহ বেকারিদ্রব্যে রয়েছে বিষ সমতুল্য রং আর মুড়িতে মেশানো হচ্ছে কৃষি কাজে ব্যবহৃত ইউরিয়া সার। এর বাইরেও রয়েছে নানা রাসায়নিক সংমিশ্রণের কারসাজি। ল্যাবে পরীক্ষায় দেখা গেছে, ফলের মধ্যে আঙ্গুর, আপেল ও নাশপাতিতে ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। এতে ফল দীর্ঘদিন দোকানে রাখার পরও নষ্ট হয় না, ঝরে পড়ে না। এসব ফল খেলে গ্যাস্ট্রিক-আলসারের সমস্যা বেড়ে যায়। এসব ফল লিভারের জন্য খুবই ক্ষতিকর। শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। গর্ভের শিশুরও ক্ষতি হতে পারে। ফুসফুসে ব্যাধি ও ক্যান্সারের ঝুঁকিও রয়েছে। আম, পেঁপে ও আনারস পাকানো হয় ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে। কেমিক্যাল মেশানো এসব ফল একটু ভালো করে দেখলেই বোঝা যায়। প্রাকৃতিকভাবে পাকা আম বা পেঁপের মুখের দিকটা হলুদ হয়ে নিচে আস্তে আস্তে রঙ বদলায়। পেকে যাওয়ার পরও নিচের দিকটায় সবুজ থাকার প্রবণতা থাকে। কিন্তু কেমিক্যাল মেশানো ফলে ছাকরা ছাকরা রং থাকে। স্বাভাবিক গন্ধও থাকে না। অর্গানিক এসিড মিশে ফলকে একটি মিষ্টি স্বাদ এনে দেয়, খোসাতেও মিষ্টি একটা ভাব চলে আসে। আরও কেমিক্যাল মেশালে তা হয়ে যায় তেতো। এসব কার্বাইড মেশালে ফলের কোনো পুষ্টিগুণই থাকে না। এসব ফল খেলে হজমের সমস্যাও হতে পারে। খাবারে রং মেশানো আমের জুস বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়। এতে আছে ফলের গন্ধ মেশানো কেমিক্যাল এবং কাপড়ে ব্যবহার করা রং। এসব রং শরীরের জন্য ক্ষতিকর। খাবারের রঙের দাম বেশি বলে ব্যবসায়ীরা কাপড়ের রং ব্যবহার করছেন। দুধেও ফরমালিন দেওয়া হয়। ওই দুধের স্বাদ কখনোই ঠিক থাকে না। ভেজাল দেয়া বা ভেজাল খাদ্য ও পানীয় বিক্রির কারণে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। এ আইনের ২৫(গ) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোনো খাদ্য বা পানীয়দ্রব্যে ভেজাল দিয়ে তা ভক্ষণ বা পান করার অযোগ্য করে ও তা খাদ্য, পানীয় হিসেবে বিক্রি করতে চায় বা তা খাদ্য বা পানীয় হিসেবে বিক্রি হবে বলে জানা সত্তে¡ও অনুরূপ ভেজাল দেয় অথবা কোনো দ্রব্য নষ্ট হয়েছে বা নষ্ট করা হয়েছে বা খাদ্য, পানীয় হিসেবে অযোগ্য হয়েছে জানা সত্তে¡ও বা তদ্রুপ বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্তে¡ও অনুরূপ কোনো দ্রব্য বিক্রি করে বা বিক্রির জন্য উপস্থিত করে; তবে সে ব্যক্তি মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড অথবা ১৪ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ডে এবং তদুপরি জরিমানা হবে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ২০০৫ সালে অর্ধশত বছরের পুরনো ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশে (পিএফও) বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনে। মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো দ্রব্য, কোনো খাদ্যপণ্যের সঙ্গে যার মিশ্রণ কোনো আইন বা বিধির অধীনে নিষিদ্ধ, এরূপ দ্রব্য মিশ্রিত কোনো পণ্য বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ হিসেবে স্বীকৃত। এ জন্য আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে।
বিএসটিআই অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এবং এর অধীনে প্রণীত বিধিমালায় খাদ্য ও কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা পদ্ধতির জাতীয় মান প্রণয়ন এবং প্রণীত মানের ভিত্তিতে পণ্যসামগ্রীর গুণগত মান পরীক্ষা ও যাচাই করার বিধান রয়েছে। পালনীয় বিধানাবলি ভঙ্গের জন্য চার বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। খাদ্যে ভেজাল রোধ ও ভেজালকারীদের শাস্তি দেয়ার বিধান রয়েছে সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশগুলোয়। দেখা যাচ্ছে, দেশে খাদ্যদ্রব্যে ভেজালবিরোধী আইনের কমতি নেই। শাস্তির বিধানও রয়েছে এসব আইনে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, শাস্তির বিধানসংবলিত এসব আইন বলবৎ থাকা সত্তে¡ও খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের এত দৌরাত্ম্য কেন? কারাদন্ডের বিধান থাকলেও এ পর্যন্ত তা প্রয়োগের কোনো নজির নেই। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। খাদ্যে ভেজাল রোধে অনেক আইন রয়েছে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার পর দেওয়া হয়নি প্রয়োজনীয় লোকবল। ভোক্তা অধিকার আইন পাস হওয়ার পর ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল থেকে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এর আগে ২০০৯ সালের ২৪ নভেম্বর ২৯ সদস্যের কাউন্সিল গঠনের পর থেকেই মূলত এর কার্যক্রম শুরু হয়। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিয়োগ হয় ২০০৯ সালের নভেম্বরে। অধিদপ্তরের জন্য ২২৩টি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে, যার মধ্যে ১০১ জন অফিসার। তবে এ পর্যন্ত প্রেষণে এবং সংযুক্তির মাধ্যমে সাতজন কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। সারা দেশে ৭২টি অফিসের মধ্যে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও খুলনায় দুটি অফিস চালু করা হয়েছে। ওই দুই অফিসেই থাকছেন দুইজন কর্মকর্তা। তবে এই জনবল নিয়েই চলছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম। প্রশ্ন হলো জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এ অবস্থা কেন?
প্রশ্ন একটাই, দেশের জনগণ কী খাবে? মাছে, দুধে ফরমালিন, ফলমূলে কার্বাইডসহ নানা বিষাক্ত ক্যামিকেল, সবজিতে রাসায়নিক কীটনাশক, জিলাপি-চানাচুরে মবিল, বিস্কুট, আইসক্রিম, কোল্ড ড্রিংস, জুস, সেমাই, আচার, নুডুলস আর মিষ্টিতে ডায়িং কারখানার রং, মুড়িতে ইউরিয়া-হাইডেন্সাজ, পানিতে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, লেড, ইকোলাই। ভেজাল খাবার খেয়ে আমরা জাতিকে ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। নতুন প্রজন্মকে মেধাহীন পঙ্গু জীবনের মতো এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছি।
আমরা মনে করি, খাদ্যে ভেজালের অপরাধে দেশে কঠিন শাস্তিযোগ্য আইন থাকলেও তার কার্যকারিতা নেই। এ অবস্থাই ভেজালকারীদের উৎসাহিত করছে। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। ভেজালের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আমজনতা, প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট বিভাগের সবাই মিলে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা প্রদর্শনের কোনই সুযোগ নেই।
লেখক: সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন