কয়েক হাজার বছর আগে আগুন জ্বালানোর কাজে তামাকপাতা ব্যবহার করা হতো। এর কারণ তামাকপাতায় খুব তাড়াতাড়ি আগুন ধরে। রান্নাবান্নার কাজেও এ পাতা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তামাকপাতা জ্বালালে এক ধরনের ধোঁয়া উৎপন্ন হতো। এতে অবশ্য আশপাশের মশা-পোকা-মাকড় পালিয়ে যেত। এই পাতার ব্যবহার ক্রমশ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তার প্রধান কারণ এর ধোঁয়া। দেখা গেল, এই ধোঁয়া নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরের ভেতরে প্রেবেশ করলে বেশ একটা মাদকতার সৃষ্টি করে। সেই থেকে মানুষ তামাকপাতাকে ধূমপানের কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে।
আমাদের এ অঞ্চলে তামাকপাতার রফতানি শুরু হয় ১৭০০ শতাব্দীতে। ভারতের বাইরে পর্তুগিজরা এই পাতার ব্যবহার প্রথম শুরু করে। বর্তমানে সিগারেট, চুরুট, বিড়ি, পাইপ ও হুঁকো নানাভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, যাদের তৈরির একমাত্র উপাদান হলো তামাকপাতা। তামাকপাতার মধ্যে নিকোটিন নামক একটি অ্যালকালয়েড আছে, যা হৃদস্পন্দন ও রক্তের চাপ বাড়িয়ে দেয় বলে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা মনে করেন, তামাকপাতার রঙের সঙ্গে নিকোটিনের এক গভীর সম্পর্ক আছে। তামাকপাতার রঙ যত বেশি কালচে বা খয়েরি হবে তাতে তত বেশি নিকোটিন থাকবে। চুরুট বা হুঁকোর জন্য কালচে পাতা ব্যবহার করা হয় যার নিকোটিনের পরিমাণ ৩ থেকে ৭ শতাংশ। সে তুলনায় সাধারণ সিগারেটে ১ থেকে ৩ শতাংশ নিকোটিন থাকে। ধূমপান করার সময় যদি একটি আচ্ছাদন বা ফিল্টার ব্যবহার করা যায় তা হলে ধোঁয়া অনেক পরিশোধিত হয়ে তবেই শরীরে প্রবেশ করে। সিগারেটের তুলনায় বিড়ি, চুরুট ও পাইপে অনেক বেশি কড়া তামাক পাতা ব্যবহার করা হয়।
‘ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর’-এই সতর্কবার্তা লেখা শুরু হয়েছে আমাদের দেশে বেশ ক’বছর থেকেই। ধূমপানে মুখ, দাঁত, জিভ ও ঠোঁটের ক্ষতি করে। ধূমপান থেকে ফুসফুসে, গলার নালিতে কর্কট রোগ হবার আশঙ্কা অত্যন্ত প্রবল থাকে। গর্ভবতী অবস্থায় মহিলারা ধূমপান করলে সিগারেটের ধোঁয়া শরীরের মধ্য দিয়ে প্লাসেন্টার ভেতর প্রবেশ করে এবং গর্ভস্থ সন্তানের রক্তে মিশে যেতে পারে। এর ফলে রক্তে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিতে পারে এবং তা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। তাছাড়া ধূমপানে আসক্ত মহিলাদের গর্ভস্থ সন্তান বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপুষ্ট ও ক্ষণজীবী হয় বলে চিকিৎসাবিজ্ঞান দাবি করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ধূমপান অকাল গর্ভপাতেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলে চিকিৎসকরা হুঁশিয়ারি প্রায়শই দিয়ে থাকেন।
তবে হালফিলের বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, ধূমপানের সময় তামাকের পোড়া পাতার ধোয়ায় এনএনকে নামক একটি অত্যন্ত ক্ষতিকারক বস্তু পাওয়া গেছে। নিকোটিন যখন পুড়তে শুরু করে তখন পোড়া ছাই থেকে এনএনকে বস্তুটির সৃষ্টি হয় সেটা নাকি কর্কট রোগের অন্যতম কারণ। বিজ্ঞানীারা শুধু বলেন না, দাবিও করেন, সিগারেটের ধোঁয়ায় শুধুমাত্র ১টি নয়, ৪০ টিরও বেশি ক্ষতিকারক পদার্থ আছে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা যেটা বলে বেড়াচ্ছেন সেটি হল, কখনও ধূমপানে অভ্যস্ত হওয়া উচিত নয়। তারা একটি তত্ত¡ আবিস্কার করেছেন। সেটি হল, cigarette tells upon your heart and picks your pocket at the same time. মোদ্দা কথা হল, ‘যার শিল যার নোড়া তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া’।
সিগারেট যারা পছন্দ করেন না তাদের অনেক ধন্যবাদ, কিন্তু যেসব মানুষ সিগারেট ছাড়া বাঁচতে পারবেন না বলে দাবি করে আসছেন তারা যে সব তত্ত¡ বা তথ্য পেশ করছেন সেগুলো কতটা যুক্তিযুক্ত একবার বিচার করে দেখতে দোষ কী? সিগারেটের মাদকতা শুধু মানুষকে চিরবন্দি করে রাখে না সে যে চিরসঙ্গী হতে পারে তার অনেক অনেক প্রমাণ দাঁড়িয়ে আছে ‘কফি হাউসে’ রেজিস্ট্রারে। এই সেই ‘কফিহাউস’ যেখানে সকাল সকাল না এলে বসারই জায়গা মেলে না-আর যদি বসাই না গেল তবে হরেক রকমের চরিত্রগুলোর জন্ম হবে কী করে? তাই তো সাতসকাল কফি হাউসের দরজা খুলতে না খুলতেই ছুটে হাজির হোন বিদগ্ধ নাট্যকার, সাহিত্যিক, কবি, পরিচালক এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকরা। এক কাপ গরম কফির সঙ্গে সিগারেট আর চোখ-কান খরগোসের মতো সজাগ রেখে চরিত্রগুলোর পেছনে ধাওয়া করা মুখে সিগারেট গুঁজে নাট্যকার খুঁজতে এমন একটি সংলাপ যা পেলে তাঁর নাটকটি অ্যাকডেমি পুরস্কারে ভূষিত হবে- তেমনি কবি চাইছেন এমন একটি ছন্দ বা শব্দের দ্যুতি যা নাকি হাজার চেষ্টাতেও তার কলমে জুটছেনা কিংবা কোনও সম্পাদক খুঁজছেন এমন একটি জ্বলন্ত ঘটনা, যা নাকি কালকের খবরের কাগজের শিরোনাম হবে। তবে কি একটি সিগারেটের এত বড় ক্ষমতা যে সে কোনও সংলাপ তৈরিতে শব্দের ছন্দ বা জুটি মেলাতে কিংবা জ্বলন্ত ঘটনাকে ধোঁয়ার তুলিতে শেষ টান দিতে পারে-নিশ্চয়ই পারে তা না হলে সিগারেট কোনও সোনার বাক্সে বন্দি হয়ে না থেকে হাত বদল হয়। নাট্যকার থেকে সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক কিংবা সম্পাদকের হাতে আর গভীর রাতে সিগারেটের এক একটি পাফ যেন এক একটি চরিত্রের নতুন সৃষ্টিকার। শুধু সিগারেটই পারে কোন সাহিত্যিককে এমন একটি চরিত্র তাঁর কলমে তুলে দিতে যা কিনা হতে পারে এক চিরদিনের অমর চরিত্র-নাট্যকার, কবি, সাহিত্যিক, সম্পাদক কিংবা গোয়েন্দা কাহিনীকার শার্লক হোমসরা বার বার বলে গেছেন যে মানুষের চরিত্রগুলো রহস্যে ঘেরা আর সিগারেটের ধোঁয়ারাও রহস্যে আবৃত। তাই সিগারেটের ধোঁয়াই পারে প্রত্যেকটি চরিত্রের রহস্যের বেড়াজাল উন্মোচন করে খুঁজে বের করতে তার শক্তিশালী দিকগুলো এবং দুর্বল দিকগুলোকে আর এই দুইয়ের উৎকৃষ্টতায় সৃষ্টি হয় এক শ্রেষ্ঠ চরিত্রের।
সবার কথাই বোধহয় শেষ শুধু একজন ছাড়া, যিনি বললেন সিগারেট নিয়ে শেষ কথা। অর্থাৎ তিনি যা বলবেন বা বিধান দেবেন সেটাই হবে ‘শেষ রায়’। বড় কৌতূহল জাগে কে তিনি? তিনি এই জগতের সৃষ্টিকর্তার মানসপুত্র ‘চিকিৎসকবৃন্দ’, মানুষ যাদের মাথায় তুলে রাখে-আর ইতিহাস যাদের নিত্য পাতা উল্টিয়ে খোঁজে তাই চিকিৎসকরা সিগারেট নিয়ে বলছেন, ‘যখন আমরা আপাদমস্তক সাদা এপ্রোনে মোড়া চিকিৎসক তখন আমরা সমস্ত মানুষকে বলব আপনারা নিজেকে সিগারেট থেকে দূরে রাখুন, কেননা সে এক নিঃশব্দ ঘাতক।’
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন