আমরা খাবার যাই খাই না কেন, মনে হয় বিষ খাচ্ছি না তো? মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ফরমালিনের দৌরাত্ম আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি। রাজধানীর বাজারগুলোতে তো বটেই দেশের বাইরে সর্বত্রই ফরমালিনযুক্ত খাবার। কিছুতেই ফরমালিন নামক এই বিষের বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না। ফলমূল, মাছ, মাংস ও খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন ব্যবহারের বিরুেিদ্ধ একের পর এক অভিযান চালানো হলেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের নিবৃত্ত রাখা সম্ভব হচ্ছে না নকল-ভেজালের দুষ্কর্ম থেকে। আতঙ্কগ্রস্থ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে রাজধানীতে গড়ে উঠছে একের পর এক ফরমালিনমুক্ত বাজার। বলা হচ্ছে প্রতিটি পণ্য পরীক্ষা করে এসব বাজারে ঢোকানো হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে তথাকথিত ফরমালিনমুক্ত বাজারেও রাসায়নিক মিশ্রিত পণ্যের বেচাকেনা চলছে। ফরমালিনমুক্ত পণ্য এই অজুহাতে অতিরিক্ত দাম রাখা হলেও ক্রেতারা টাকা দিয়ে কার্যত কিনছেন মৃত্যুপরোয়ানা।
দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। উৎপাদনে এসেছে আধুনিকতা। মাঠে উৎপাদন বেড়েছে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে চাষাবাদ লাভজনক হয়ে উঠেছে। কৃষিবাজার ব্যবস্থাপনায়ও এসেছে নতুনত্ব। নতুন নতুন ফসলের প্রতি কৃষকের আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে। নতুন নতুন ফসল বাজারে আসছে। একই মাঠে একাধিক ফসল উৎপাদনের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। নতুন নতুন গবেষণা থেকে দেশের কৃষি উৎপাদনে রীতিমতো বিপ্লব এসেছে বলা যেতে পারে। ভবিষ্যতে আরো উন্নতির আশা করছে বাংলাদেশ। শুধু ধান কিংবা গম নয়, বিভিন্ন জাতের মৌসুমি সবজি উৎপাদনেও এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। দেশের বিভিন্ন স্থানে সবজি চাষ করেও লাভবান হচ্ছে কৃষক। এর পাশাপাশি পশু পালনও এখন গ্রামাঞ্চলে পেশা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। পশু পালন আমাদের অর্থনীতিতে গতি এনেছে, পুষ্টি চাহিদাও পূরণ করছে।
খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে কী খাচ্ছি আমরা? এ প্রশ্নটা এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে জমিতে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার। কীটনাশক ব্যবহার করতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৃষক মাত্রা না বুঝে মাঠে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করে থাকে। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে অনেক সবজিই খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায়। কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে খাদ্যে ফরমালিনসহ রাসায়নিকের ব্যবহার নিয়ে হৈ চৈ হচ্ছে। উচ্চ আদালত থেকেও এই মর্মে কিছু নির্দেশনা এসেছে । খাদ্যে ফরমালিন এখন এক ভয়াবহ আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। মর্গে মানুষের লাশ ও গবেষণাগারে প্রাণীর মৃতদেহ সংরক্ষণে যে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়, সে ফরমালিন এখন ব্যবহার করা হচ্ছে খাদ্যদ্রব্যের পচন রোধ করার কাজে। মাছ বিক্রেতারা মাছের পচন রোধ করার জন্য ফরমালিন ব্যবহার করছে। একইভাবে দুধ যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্যও ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে। ইদানীং মাংসেও নাকি ফরমালিন ব্যবহার হচ্ছে। অথচ এই ফরমালিন মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
ফরমালিন মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে, কিডনি, লিভার ও শ্বাসতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। উন্নত বিশ্বে শুধু খাদ্যে নয়, অন্যান্য সামগ্রীতেও এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কারণ নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি ফরমালিনযুক্ত দ্রব্যের সংস্পর্শে থাকলে এলার্জি, শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ নানাবিধ শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে এর আমদানি ও ব্যবহার চলছে অবাধে। তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্যের ওপর। আদালতের নির্দেশনাগুলোর মধ্যে ছিল বন্দরগুলোতে রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো ফল আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা, বাজারের আড়তগুলোতে প্রতিদিন ফলের রাসায়নিক পরীক্ষা করা ও দোষীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা ইত্যাদি। কিন্তু এসব নির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
ফরমালিনসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগের অভাবে অপরাধীরা যা ইচ্ছা তাই করার সুযোগ পাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য জিম্মি হয়ে পড়েছে অসৎ ব্যবসায়ীদের কাছে। এ অবস্থার প্রতিকার ঘটাতে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত হওয়া দরকার। ফরমালিন ব্যবহারকারীদের কঠোর শাস্তিই তাদের অপরাধপ্রবণতায় বাদ সাধতে পারে।
দেশের প্রতিটি হাট-বাজারে ফরমালিন ও ভেজাল শনাক্তকরণ যন্ত্র ভোক্তাদের হাতের নাগালে পর্যাপ্ত রাখা দরকার। যেমন পশুহাটগুলোতে রাখা হয়েছে জালটাকা শনাক্তকরণ যন্ত্র। কোন মাছে কতোটা ফরমালিন, কোন শাক সবজিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের উপস্থিতি, কোন খাদ্যদ্রব্য কতোটা ভেজাল তা সহজে শনাক্ত করতে না পারার কারণে অসাধু কারবারীদেরই যেন রাজত্ব। বাজারে এমন একজন ভোক্তাও পাওয়া যাবে না যে, তিনি জেনেশুনে ক্ষতিকর ভেজাল দ্রব্য কিনবেন। যে ব্যক্তি ভেজাল করেন, অসাধু, তিনিও নিজের বেলায় ভালোটাই খোঁজেন।
বাজারে ফলফলারি নিশ্চিন্তে কেনার জো নেই, খেজুরের গুড়? তাতেও নেই আসল স্বাদ। মাছ? মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে কিছুটা স্বস্তি মিললেও অভিযান ঝিমিয়ে গেলে পূর্বাবস্থায় ফেরে। গুড়ো মশলা? কোনটার সাথে কোন ধরনের অখাদ্য কু-খাদ্য যে মেশানো হয়, তা বোঝা ভার। গুড়ো ঝালের সাথে পোড়ামাটি মেশানোর উদাহরণ এই জনপদে রয়েছে। মজমা করে দাঁতের ভালো মাজন বলে ঘুটোর ছাই বিক্রিরও নজির রয়েছে এই সমাজে। সরষের তেল? ঝাঁঝটা বেশি হলেও আসলটা বাজারে নেই বললেই চলে। ভাবছেন, এক দু মুঠো মুড়ি খাবেন? গিন্নিরটা বাদে বাজার থেকে কিনলে তাতে ইউরিয়ার উপস্থিতি স্পষ্ট। এই যখন পরিস্থিতি, তখন প্রতিকারের উপায়? ভেজালমুক্ত গুড় কিংবা সারছাড়া মুড়ি পেতে অবশ্যই দরকার, ভেজাল ও রাসায়নিক অবাঞ্ছিত পদার্থ শনাক্তকরণ যন্ত্র। কোন শাকে বিষ, কোন মাছে পচনরোধক রাসায়নিক পদার্থ তা শনাক্ত করতে পারলে ভোক্তারাই শুধু উপকৃত হবেন না, উৎপাদক ও বিক্রেতাদেরও বাড়বে কদর। যেহেতু সকলেই সুস্থ থাকার স্বপ্ন দেখে, সেহেতু সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে আসবে সফলতা।
লেখক: গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন