বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মানুষ কেন নিঃস্ব হচ্ছে

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন | প্রকাশের সময় : ৩ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে যখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে না তখন সেখানে শান্তি ও সুখ বিরাজ করে না। আর সমাজের সব ঘটনা সবাইকে এক রকম করে ভাবায় না। দেশের কিছু মানুষ চোখের সামনে নিঃস্ব হচ্ছে অথচ প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে যখন বাংলাদেশ তখনও রাষ্ট্রের কিছু মানুষের নিঃস্ব হওয়ার করুণ কাহিনী সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে। মানুষ অনেক কারণে নিঃস্ব বা ফতুর হচ্ছে, তবে চিকিৎসা, মামলা আর নদী ভাঙ্গন বিশেষ উল্লেখযোগ্য কারণ।
চিকিৎসা: উন্নয়নশীল বিশ্বে স্বাস্থ্য সেবাকে যেখানে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় সেখানে বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসা সেবার মৌলিক অধিকার থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- যার টাকা আছে সে চিকিৎসা পাবে, যার টাকা নেই সে বারান্দায় অথবা হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসাহীনভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। নিকট অতীতে ঢাকা শহরের বড় তিন তিনটা সরকারি হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে কোথাও জায়গা না পেয়ে হাসপাতালের সামনের ফুটপাতে এক অসহায় মা সন্তান প্রসব করে। তার সে শিশুসন্তানটি বাঁচেনি। জন্মের দুই মিনিট পরই তার নিথর দেহ ফুটপাতে পড়ে থাকে। অমানবিক নির্মম এ দৃশ্য এটাই প্রথম নয়, বহু ঘটনা অজানাই থেকে যায়। জীবন রক্ষা করে যে ওষুধ তার দামও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে চললেও লাগাম টেনে ধরার ক্ষমতা ওষুধ প্রশাসনের নেই।
২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ব্যক্তির স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধি সম্পর্কে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ ১৯৯৭-২০১৫ পর্যন্ত স্বাস্থ্য ব্যয়ের উপর যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তা সত্যিই হতাশাজনক। ওই প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে দেশের স্বাস্থ্য খাতে যে অর্থ ব্যয় হয় তার ২৩ ভাগ বহন করে সরকার আর ৬৭ ভাগ ব্যয় বহন করে জনগণ। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসার জন্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে। স্বাস্থ্যখাতে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ যেখানে সর্বোচ্চ থাকা উচিত সেখানে রয়েছে জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ বরাদ্দ। একশ্রেণির নীতিহীন ডাক্তার, ওষুধ কোম্পানি ও হাসপাতালের কাছে মানুষ জিম্মি। অস্বাভাবিকভাবে চিকিৎসকদের রোগী দেখার ফি, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয়, ব্যবস্থাপত্রে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লেখা বা প্রয়োজন ছাড়াও অস্ত্রোপচারের পথ ধরায় স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যয় বেড়েই চলেছে।
একটি ওষুধ কোম্পানি তাদের উৎপাদিত ওষুধ বাজারজাত করার জন্য ডাক্তারদের গিফট ডোনেশনের নামে লক্ষ-কোটি টাকা দিতে পারে। কিন্তু কম মূল্যে মানবসেবার জন্য ওষুধ বাজারজাত করতে পারে না। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর অবস্থা তো আরো নাজুক। তাঁরা চিকিৎসা সেবাকে পুঁজি করে হরিলুট করলেও দেখার কেউ নেই। তবে এটাও ঠিক সরকারি হাসপাতালের অবস্থা যদি ভালো থাকতো তাহলে প্রাইভেট হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকের প্রয়োজন হতো না। ২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বর মহামান্য হাইকোর্ট হাসপাতালে লাশ আটকে বিল নেয়া প্রসঙ্গে এক যুগান্তকারী আদেশ দিয়েছিলেন। ২০১২ সালে ৪২ হাজার টাকার বকেয়া বিলের মধ্যে ১৫ হাজার টাকা শোধ করেও এক নবজাতকের বাবা-মা তাদের সন্তানের লাশ ফেলে যেতে বাধ্য হন। এ বিষয়ে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট পাঁচ বছর পরে ওই আদেশ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের কোনো বেসরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবা পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। পশ্চিমবঙ্গের একটি হাসপাতালে বিল পরিশোধ করতে না পারায় বিনা চিকিৎসায় ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীর মৃত্যু হয়। হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে, তারা পাওনা অর্থের জন্য চেক ও ফিক্সড ডিপোজিট আদায় করেই রোগীর লাশ হস্তান্তর করেছিল। গণমাধ্যমে ওই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর মেডিকেল নেগলিজেন্স রোধে মমতা সরকার একটি রেগুলেটরি কমিশন গঠন ও বিধানসভায় একটি বিল আনার ঘোষণা দেয়। বিধানসভার পাস করা আইনে মাত্রাতিরিক্ত বিল আদায়, বিলের জন্য লাশ আটকে রাখা এবং দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করাকে ফৌজদারি অপরাধ গণ্য করা হয় এবং এ সংক্রান্ত বিরোধ মেটাতে একটি স্থায়ী রেগুলেটরি কমিশন গঠন করা হয়। বাংলাদেশেও যদি এরকম একটা রেগুলেটরি কমিশন গঠন করা যায় তাহলে হাজারো মানুষকে নিঃস্ব হওয়ার হাত থেকে রক্ষা সম্ভব।
মামলা: আইন কানুন যতই সুন্দর হোক না কেন তা যদি বাস্তবায়নকারী মানুষের অন্তরে হক ও ইনসাফ সৃষ্টি করতে না পারে তাহলে সেখানে ন্যায়ের জায়গায় অন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে। আইনের সুশাসনের কথা বইয়ের পাতায় এখনো পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে আইনের সুশাসন তেমন দেখা যায় না বলেই মানুষ মামলার খরচ চালাতে গিয়ে ফতুর হচ্ছে। কারণ একটি মামলা যুগের পর যুগ ধরে চলছে। ‘সম্প্রতি রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন ৩৩ লাখ মামলার বোঝা নিয়ে বিচার বিভাগ চলছে। তিনি আরো বলেন মামলার জট কমিয়ে আনা বিচারকদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।’ বাংলাদেশের নি¤œ আদালত ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট, জজ কোর্টের পাশাপাশি উচ্চ আদালতেও অসংখ্য মামলা পড়ে আছে, যা বছরের পর বছর ধরে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক তথ্য মতে, সারা দেশের আদালতগুলোতে ৩৩ লাখ ৯ হাজার ৭৮৯টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৩১৫টি মামলা। এর মধ্যে আপিল বিভাগে রয়েছে ১৬ হাজার ৫৬৫টি মামলা। হাইকোর্ট বিভাগে রয়েছে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৭৫০টি মামলা। বাকি মামলাগুলো নিম্ন আদালতের বিচারধীন রয়েছে। আইনের শাসনের ভিত্তিতে পরিচালিত কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে পুলিশ নাগরিকদের হেনস্তা করতে পারে না। সুনির্দিষ্ট ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ যে কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারে। কিন্তু মনগড়া সন্দেহের বশবর্তী হয়ে পাইকারী হারে আটক করার অধিকার তার নেই। পুলিশের বাড়াবাড়ি কবেই বন্ধ হয়ে যেত যদি রাজনীতির গতিপথ রাজনীতির মধ্যে বিচরণ করতো। দুঃখজনক হলেও সত্য, ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রের আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীকে তাদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেন। সুবিচারের স্বার্থে নাগরিকদের কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্র সুবিচারের জন্য আইনের সংস্কার করতে পারে। আমরা ইতিহাসের আব্বাসী ও মুঘল যুগের বিচারব্যবস্থার দিকে নজর দিতে পারি। ঐ সময়ের সব কিছু আমরা নিতে পারব না। কিন্তু সে ব্যবস্থার ভালো দিকগুলো যদি আমরা নিতে পারি তাহলে সহজেই মানুষ সুবিচার পাবে।
নদী ভাঙ্গন: বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও অনেক নদী মৃত্যুপ্রায়। ৭১৫ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষের বসবাস। ওই সব এলাকার মানুষগুলোর জীবন মোরা, রোয়ানু, সিডর, আইলা, নার্গিসের মতো ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। মানুষের জানমাল রক্ষার্থে সরকারের নানা রকমের পরিকল্পনা থাকা স্বত্তে¡ও মানুষ দিন দিন ঘুর্ণিঝড় বা নদী ভাঙ্গনের ফলে নিঃস্ব হচ্ছে। ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের কথা এখনও সাগর পাড়ের মানুষ ভুলেনি। বাংলাদেশ বর্হিবিশ্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে সকল দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কথা, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। উপকূলীয় ভূভাগ রক্ষায় ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তার যে ধরনের উদ্যোগ ও পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া প্রয়োজন তা কিন্তু পরিলক্ষিত হচ্ছে না। স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং বৃক্ষবেষ্টনী গড়ে তোলার অতি জরুরি কাজটুকু সরকার করতে পারছে না। দেশের উপকূল অরক্ষিত রেখে দেশকে সুরক্ষিত করা মোটেও সম্ভবপর নয়! প্রতিবছর বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করা হলেও বাঁধ স্থায়ী ও টেকসই করে নির্মাণ সম্ভব হয়নি। অর্থের বেশি ভাগই ক্ষমতাসীনদের পকেটে চলে যায় বিধায় ওইসব এলাকার মানুষের ভাগ্যের পরির্বতন তো হয়নি উল্টো নদীর গভীরে বসতভিটা চলে যাচ্ছে। যে কারণে প্রতিবছর নদী ভাঙ্গনের ফলে লাখো মানুষ ফতুর হচ্ছে। প্রতিটি জেলায় নদী ভাঙ্গন রোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকরী উদ্যোগ এখনই গ্রহণ করা প্রয়োজন। মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও দেশের প্রতিটি নাগরিকের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা যতই চমৎকার হোক তাতে জনগণের কিছু যায় আসে না যদি না সেই পরিকল্পনা নিঃস্ব মানুষকে রক্ষা করতে পারে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন