“জুন মাস” আসতেই শুরু হয় বাজেটের তোড়জোড়; টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয় বাজেট। চলে বাজেটের নানা চুলচেরা বিশ্লেষণ। ১৯৭২ সালে তাজউদ্দিন আহমেদের হাতে যাত্রা শুরু হওয়া মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট এ বছর রূপ নিয়েছে চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকাতে। এটি দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বাজেট। ফলে জুন মাস অর্থনীতিবিদদের কাছে বাজেট মাস হিসেবেই পরিচিত। বাংলাদেশে জুন মাসে বাজেট দিলেও পৃথিবীর বহু দেশে রয়েছে অর্থবছরের ভিন্নতা। কৌতূহল জাগে, কবে শুরু হয় উন্নত বিশ্বের বাজেট যাত্রা, কতই বা থাকে বাজেটের আকার; কীভাবে পাস হয় বাজেট, এরকম প্রশ্নের উত্তর দিতেই বিশ্ব বাজেটের খুঁটিনাটি নিয়ে এই আয়োজন “বিশ্ব বাজেটের আদ্যোপান্ত”।
বাজেটের উৎপত্তি : বাজেট ইংরেজি শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ ‘থলে’ বা ইংরেজিতে ব্যাগ। অতিতে থলেতে ভরে এটি আইনসভা বা সংসদে আনা হতো বলে এ দলিলটি ‘বাজেট’ নামে অভিহিত হয়ে আসছে। সর্বপ্রথম ব্রিটেনের পার্লামেন্টে প্রথম জাতীয় বাজেট ও রাজস্বনীতি উত্থাপন করেন স্যার রবার্ট ওয়ালপোল। আধুনিক বাজেটের প্রবর্তক ভারতীয় ভাইসরয়ের নির্বাহী পরিষদের অর্থ সদস্য স্যার জেমস উইলসন। জাতীয় বাজেটের মূল অংশ দুটি। প্রথম অংশ রাজস্ব আদায়সংক্রান্ত আর দ্বিতীয় অংশে থাকে সরকারি ব্যয়ের প্রস্তাবগুলো। আয়-ব্যয়ের প্রকৃতি অনুযায়ী বাজেটকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়Ñ উদ্ধৃত বাজেট ও ঘাটতি বাজেট। বিভিন্ন খাতের আয়-ব্যয়ের পরিমাণ সমন্বয় সাধন করে যে বাজেট তৈরি করা হয়, সে বাজেটকে বলে সংশোধিত বাজেট। মূল বরাদ্দের অতিরিক্ত অর্থসংবলিত যে বাজেট অনুমোদনের জন্য সংসদে পেশ করা হয় তাই সম্পূরক বাজেট।
বিভিন্ন অর্থবছরে বিশ্ব : বছরের হিসাবের জন্য পৃথিবীতে এখন প্রায় ৮০টিরও বেশি দিনপঞ্জি বা ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়। এ ছাড়া হিজরি সন, ভারতীয় পঞ্জিকার ব্যবহারও রয়েছে। কিন্তু এর বাইরে বাজেট-বর্ষ বা অর্থবছর নামে আরও একটি হিসাব চালু রয়েছে। পৃথিবীর প্রায় ১৫৪ দেশে অর্থবছর শুরু হয় ইংরেজি ক্যালেন্ডার বছর অনুযায়ী। অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে। এ ছাড়া জুলাই মাসেও অনেক দেশে অর্থবছর শুরু হয়। বাংলাদেশে সাধারণত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ বা প্রথম বৃহস্পতিবার বাজেট পেশ হয়। পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশের অর্থবছর শুরু ১ জুলাই, শেষ ৩০ জুন। চীন, ব্রাজিল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, স্পেনে অর্থবছর শুরু হয় ১ জানুয়ারি আর শেষ হয় ৩০ ডিসেম্বর। ভারত, ইংল্যান্ড, হংকং, কানাডা এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় অর্থবছর শুরু হয় ১ এপ্রিল, শেষ হয় ৩১ মার্চ। যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডে অর্থবছর শুরু হয় ১ অক্টোবর, শেষ হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। তবে ইরানের অর্থবছর হিজরি সন অনুসারে হয়ে থাকে। আর নেপালের অর্থবছর বিক্রম ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে। সাধারণত; সরকারি হিসাব-নিকাশের সুবিধার্থে অর্থবছর নির্ধারণ করা হয়।
শীর্ষ বাজেটের দেশসমূহ : শীর্ষ বাজেটের দিক দিয়ে সবার আগে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। এই দেশ দুটির বাজেট বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ সামরিক ব্যয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের কাছে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনা পেশ করে। অপরদিকে চীনের বাজেট অনুমোদন দেয় চীন ন্যাশনাল পিপলস। যুক্তরাষ্ট্রের বাজেটের অন্যতম দিক হলো ‘শার্ট ডাউন’। বাজেট পাসের অচলাবস্থাকেই এই নামে ডাকা হয়। ফলে সরকারি সেবা খাত বন্ধ হয়ে যায়, আটকে যায় সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা। ১৯৯৫ সালে রেকর্ড ২১ দিন এমন পরিস্থিতি ছিল। তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে যথাক্রমে- জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে জাপানের জাতীয় বাজেট তৈরি করে থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়। অপরদিকে, আয়তনের দিক থেকে রাশিয়া পৃথিবীর বৃহৎতম রাষ্ট্র হলেও বাজেটের অর্থের পরিমাণের দিক থেকে তাদের অবস্থান ১২তম স্থানে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট বিশ্বের ১৪তম অবস্থানে। তবে, আকার আর অর্থবছর যাই হোক না কেন, একটি দেশের উন্নতি অনেকাংশে নির্ভর করে পরিকল্পিত বাজেটের সফল বাস্তবায়ন। পরিশেষে বাজেট আর জনগণের সম্পর্ক বুঝাতে মর্কিন লেখক জ্যাকব লিউ’র কাছে ফিরতে হবে; যিনি বলেছিলেন- ‘বাজেট শুধুমাত্র অনেকগুলো সংখ্যার সমষ্টিই নয় বরং জনগণের মূল্যবোধ ও আকাঙ্খার বহিঃপ্রকাশও বটে।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন