শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বাজেট ও বাস্তবতা : দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে

প্রকাশের সময় : ১২ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে সবচেয়ে বাধা যখন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, বিনিয়োগ না হওয়া এবং রাজস্ব আদায়ে মন্থরতা তখন অর্থ মন্ত্রণালয় ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৬ কোটি টাকার বাজেট চূড়ান্ত করেছে, যা চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ৪৪ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা বেশি। চূড়ান্তকৃত এই বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধি আশা করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। সম্ভাব্য মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। এযাবৎকালের মধ্যে এই বাজেট প্রস্তাবনা সবচেয়ে বড় হলেও দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপট ও উন্নয়ন আকাক্সক্ষার নিরিখে একে উচ্চাভিলাষী বলার কোনো সুযোগ নেই। এ বাজেট বাস্তবায়ন-অযোগ্য বলেও মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাজেটে যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন কি আদৌ সম্ভব হবে? অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এর উত্তর নেতিবাচক হতে বাধ্য। সঙ্গতকারণেই আলোচনায় আসতে পারে চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের সাফল্য-ব্যর্থতার দিকগুলো। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ কম। সংক্ষেপে বলা যায়, বাজেট বাস্তবায়নের চিত্র হতাশাজনক। চলতি বছরের বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ইতোমধ্যেই তা ব্যাপকভাবে কাটছাঁট করে সংশোধন করা হয়েছে। কাটছাঁটকৃত অর্থের পরিমাণ ৩১ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৯৯৭ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবায়ন সøথতার কারণে ইতোমধ্যে এডিপিতে ৭ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। বিগত ৯ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৪১ শতাংশ। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে ৩১ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। মন্থরতার ঘেরা টোপ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। বলা যায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে প্রধান তিনটি চ্যালেঞ্জ হুবহু বিদ্যমান রয়েছে। বলা হচ্ছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের মতো হবে যদিও এই আশাবাদ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এই প্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত বাজেটে বর্ণিত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কতদূর সম্ভব হবে তা অবশ্যই একটা বড় প্রশ্ন।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজেটের আকার কতটা বড় বা ছোট সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তার বাস্তবায়ন। তারা মনে করেন, এক্ষেত্রে বিবিধ সঙ্কট রয়েছে। এর মধ্যে বাস্তবায়ন সক্ষমতার অভাবই প্রধান। এই সঙ্গে রয়েছে দুর্নীতি, অর্থপাচার, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, বিনিয়োগ পরিবেশের ঘাটতি, অবনত আইনশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ইত্যাদি। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ধীরগতি ও অপারগতা এবং রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারার পেছনে বাস্তবায়ন সক্ষমতার অভাবই মূলত দায়ী। এছাড়া দুর্নীতির যে চাষাবাদ দেশে চলছে তাতে কোনো কিছুই ঠিকমতো করা বা হওয়া সম্ভব নয়। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি বিস্তার লাভ না করেছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সামাজিক ভারসাম্য যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করছে তেমনি এই অর্থের বড় অংশটি পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে ব্যাংকিং খাত থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। এছাড়া অন্যান্যভাবেও টাকা পাচার হয়েছে। এ টাকার একাংশ সেকেন্ড হোম করতে ব্যয় হয়েছে, অপরাংশ বিনিয়োগ হয়েছে। অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকা দেশের কোনো কাজে আসেনি। প্রতিটি বাজেটের সময় কালো টাকা বিনিয়োগ করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। সুযোগও দেয়া হয়। কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া যায় না। এবারও কালো টাকা নিঃশর্তে বিনিয়োগের দাবি জানিয়েছে রিহ্যাব। গত বছরও এ দাবি জানানো হয়েছিল। আবাসন খাত এখন মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে। প্রয়োজন ব্যাপক বিনিয়োগ। যদি কালো টাকা এ খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয় তাহলে খাতটি ফের মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। এরকম আরো বিভিন্ন খাত রয়েছে কালো টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে যাদের মেরুদ- শক্ত করা সম্ভব। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, দেশে বিনিয়োগের কাক্সিক্ষত পরিবেশ নেই। এক্ষেত্রে নানা সঙ্কট রয়েছে। পদে পদে দুর্নীতি ছাড়াও অবকাঠামো সঙ্কট, গ্যাস-বিদ্যুতের অভাব, বাহুল্য ব্যয়, নিরাপত্তাহীনতা, ভূমির অভাব, লালফিতার দৌরাত্ম, দীর্ঘসূত্রতা, উচ্চ সুদহার ইত্যাদির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিনিয়োগ ছাড়া শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, রফতানি আয় বৃদ্ধির কোনো সহজ বিকল্প নেই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ যেমন অপরিহার্য তেমনি উন্নত আইনশৃঙ্খলা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও অপরিহার্য। আইনশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ব্যাপারে চরম হতাশা ব্যক্ত করা ছাড়া উপায় নেই। চলতি অর্থবছরে রাজনৈতিক উত্তাপ তেমন না থাকলেও বাজেট ও উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। এর কারণ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিদ্যমান রয়েছে।
সরকার রাজনৈতিক সমঝোতা বা স্থিতিশীলতার চেয়ে উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশাল বিশাল উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করছে, বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করছে। সরকারি মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে, দেশে উন্নয়নের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এসব মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন কবে হবে, জনগণের ট্যাক্সের টাকা কত ব্যয় হবে, কেউ জানে না। অথচ বিদ্যমান অবস্থা কি? সাধারণ মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। তাদের আয়-ব্যয়ের ফারাক আকাশ-পাতাল। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য আকাশচুম্বী। কাজ নেই। গ্রাম থেকে মানুষ শহরে এসে কাজের জন্য হাহাকার করছে। আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ বেকার। এর মধ্য রয়েছে এক কোটির মতো শিক্ষিত বেকার। তারা চরম হতাশায় ভুগছে। খবর বেরিয়েছে, দু’জন শিক্ষিত বেকার আত্মহত্যা করেছে। এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী বেকার যুবকের আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছে। চলতি বছরের বাজেট বক্তৃতায় প্রতি বছর গড়ে ১৩ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছিল। অথচ এক খবরে পরিসংখ্যান দেখানো হয়েছে, গত দুই বছরে মাত্র ৬ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। উন্নয়নের সেøাগান দিয়ে এ কঠোর বাস্তবতা এগিয়ে যাওয়া যাবে না। সরকারকে বৃহত্তর জনগণের সঙ্কট সমাধান ও কল্যাণ সাধনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনশৃঙ্খলাজনিত সংকট নিরসনে গুরুত্ব দিতে হবে। বাজেট ও উন্নয়ন কর্মসূচির শতভাগ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। যে দৃষ্টিভঙ্গি এখন অনুসৃত হচ্ছে তা পরিবর্তন করতে হবে। গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন