শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়

প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিশ্বব্যাংক মনে করছে, চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের এ পূর্বাভাস সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত প্রাক্কলনের চেয়ে অনেক কম। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিবিএসের সাময়িক হিসাবে চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশÑ যা সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। বিবিএসের এই সাময়িক হিসাব সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবছর অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই বিবিএস এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। অন্যান্য বছর ৯ মাসের (জুলাই-মার্চ) পূর্ণাঙ্গ হিসাব পেয়ে তবেই জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়। সব হিসাব পাওয়া যায় এপ্রিলের শেষের দিকে। মূলত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি এবং ভারতীয় ও চীনা ঋণের ওপর ভর করেই এই প্রবৃদ্ধির হিসাব করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, বেতনের ভিত্তিতেই শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতের উৎপাদনশীলতা গণনা করা হয়। প্রশ্ন হলো এ প্রবৃদ্ধি টিকবে কি না। উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি না পেলে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি টিকবে কিভাবে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও মনে করেন, বিবিএসের এ হিসাব গ্রহণযোগ্য নয়। তার মতে, গত কয়েক বছরের বিনিয়োগের বিপরীতে উৎপাদন প্রবণতা ধরলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবার ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়।
এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমারে জিডিপিও এখন অনেক ঊর্ধ্বের দিকে। বাংলাদেশকেও টিকে থাকতে হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে প্রকৃত উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সম্ভাবনার অন্তরায় বা ঝুঁকি হিসেবে বিশ্বব্যাংক যেমনি মনে করে সাধারণভাবেও মনে করা হয় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন ছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। এখন বিরোধী দলের তেমন কোনো কার্যকর কর্মসূচি না থাকা সত্ত্বেও দেশের অবস্থা খুব একটা স্থিতিশীল তা বলা যাবে না। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সামগ্রিক যে বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে তা বিশেষ বার্তাবহ। মানুষের অধিকারহীনতা বিশেষ করে নির্যাতন নিগ্রহের খবর প্রতিদিনই প্রকাশিত হচ্ছে। ব্রাসেলসভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের গত সোমবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পুলিশ ও আওয়ামী যৌথ জোট একসঙ্গে বিরোধী দলের মত দমনে কাজ করছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পুলিশকে বিরোধী মত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, নেতা-কর্মীদের করা হচ্ছে বিচারের মুখোমুখি। অন্যদিকে অধিকারকর্মীরা রয়েছেন উগ্রপন্থীদের হুমকির মুখে। এ বিষয়টি কার্যত গত কয়েক বছরে নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক নিগ্রহ-নির্যাতন নিয়ে প্রায়ই বিশ্বের কোনো না কোনো মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করে যাচ্ছে। অন্যদিকে এশিয়া প্যাসিফিক মানি গ্রুপ অন মানিলন্ডারিংয়ের খসড়া মূল্যায়নে বলা হয়েছে বাংলাদেশ আবারো ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় ঢুকতে যাচ্ছে। এদিকে এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লোপাটের সাথে বাংলাদেশের কারা জড়িত তা খুঁঁজে বের করা যায়নি। কিভাবে এটা ঘটেছে তাও এখনো রহস্যাবৃত। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বেসরকারি ভোগ-ব্যয় আগের অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরে কমতে পারে। রিপোর্টে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক, আর্থিক ও বাণিজ্যে অস্থিতিশীলতা প্রধান ঝুঁকি। বিনিয়োগ বাড়ানো বড় চ্যালেঞ্জ। অবশ্যই এখানে উল্লেখ করা দরকার, বাংলাদেশের জিডিপির সাময়িক ও চূড়ান্ত হিসাব করে বিবিএস। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা এ বিষয়ে পূর্বাভাস দেয়। তবে বিবিএসের হিসাবের পদ্ধতিগত দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সঙ্গত বিবেচনা থেকেই বলা যায়, সরকার রাজনৈতিক সমঝোতাকে গুরুত্ব না দিয়েই উন্নয়ন বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। এটি প্রকৃত বিবেচনায় অবাস্তব। প্রকৃতপক্ষে প্রবৃদ্ধির সাথে যে বিনিয়োগের সম্পর্ক রয়েছে তা অর্জন করতে হলে অবশ্যই আস্থার প্রসঙ্গকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। এখন দেশে বিরোধীদের তেমন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগে তার কোনো প্রভাব পড়েছে সে কথা কোনো বিবেচনাতেই বলা যাবে না। একথা স্বীকার করতেই হবে, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া বিনিয়োগ বা কোনো ধরনের উন্নয়নই সম্ভব নয়। সে বিবেচনায় প্রবৃদ্ধি অর্জনকে কেবল যদি কাগুজে হিসাবের মধ্যে বিবেচনা করা হয় বা এক ধরনের গোঁজামিল দিয়ে চালানো হয় তাতে প্রকৃত লাভ কিছুই নেই। সে কারণেই বাস্তবতা গভীর বিবেচনায় নেয়া জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে।
এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলো যে মাত্রায় এগোচ্ছে তার সাখে পাল্লা দিয়ে চলতে না পারলে সঙ্গতভাবেই আমরা পিছিয়ে যাবো। কার্যত আমরা এখনো তুলনামূলক বিবেচনায় পিছিয়ে রয়েছি। বিদ্যমান অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরো নাজুক হতে বাধ্য। কেন এবং কোন বাস্তবতায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বা হতে পেরেছে তার গভীর বিশ্লেষণ ও তা থেকে উত্তরণের পথ খোঁজা খুবই জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৭ দশমিক পাঁচে তাদের জিডিপি। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেখানে রাজনৈতিক ফয়সালা করা হয়েছে, যার সুফল অর্থনীতিতেও পড়ছে। সব ধরনের বাধা-বিপত্তি এড়িয়ে পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকারও এ অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে অর্থনীতিতে পাল্লা দিয়ে চলছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানও চলছে। সাধারণ বিবেচনায় আমাদের অবস্থা হয়তো খারাপ নয়। বাস্তবে যে আস্থার সঙ্কট রয়েছে তার ফলে সব মহলের সম্পৃক্ততা না থাকাতেই পরিস্থিতির কাক্সিক্ষত উন্নতি হচ্ছে না। বেতন বৃদ্ধি ভারতীয়, চীনা ঋণের ওপর নির্ভর করে জিডিপির হিসাব করে তা থেকে সুফল লাভের আশা খুবই কম। বাংলাদেশের জিডিপি ৭ দশমিক পাঁচে পৌঁছতে না পারলে যে ধরনের টুকুর টুকুর করে চলতে হবে তাতে কার্যত টিকে থাকা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট সকলে সমস্যা সমাধানের মূলে কাজ করবেন- এটাই প্রত্যাশিত।

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন