শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাস্থ্য

খাদ্য ও ফরমালিন

| প্রকাশের সময় : ২৯ জুন, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

সুন্দর, স্বাস্থ্যকর ও শানিÍময় জীবনযাপনে শরীর সুরক্ষার বিকল্প নেই। নিয়মিত বিশুদ্ধ খাবার গ্রহণ এবং অখাদ্য-কুখাদ্য বর্জনই আমাদের সুস্থ জীবনযাপনের একমাত্র উপায়। আমরা সবাই বাঁচতে ভালবাসি। তাই বেঁচে থাকার জন্যই এত ঝক্কি-ঝামেলা। মানুষ খাওয়ার জন্য বাঁচে না, বাঁচার জন্য খায়। তা না হলে ডাক্তাররা রোগীদের যখন কিছু কিছু খাদ্যবস্তু সাময়িক খেতে বারণ করেন তখন রোগী ডাক্তারদের উপদেশ লঙ্ঘন করত। তাই স্বাস্থ্যের বিধিসম্মত সতর্কীকরণ, পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করে জীবনটাকে সুস্থ, রোগমুক্ত করে রাখতে কে না চায়। কিন্তু আজকাল আমরা যে সমস্ত খাবার খাচ্ছি তার অধিকাংশই ভেজাল।
নিত্যদিনের চাল, ডাল, তেল লবণসহ ঠান্ডা পানীয়দ্রব্য, ফলমূল এবং মিষ্টান্ন দ্রব্যে ভেজালের ছড়াছড়ি। যেমন কোকাকোলা, মিরান্ডা, পেপসি, ইত্যাদিতে ক্ষতিকারক রঙ এবং রাসায়নিক তরল পদার্থ ব্যবহার করে বাজারজাত করা হচ্ছে। মিষ্টান্ন দ্রব্য যেমন- জিলাপি, বুন্দিয়া, রসগোল্লা প্রভৃতি বানানোর জন্য ময়দা, আটা, সুজি ইত্যাদি ভালভাবে মেখে দু’-তিন দিন নিরাপদে রেখে পচানো হয় এবং তারপর নানা ধরনের পাউডার, রঙ মিশিয়ে হোটেল রেস্টুরেন্টে সাজিয়ে রাখা হয়। মরিচ গুঁড়ো, হলুদ গুড়ো ঝকঝকে রঙিন করার জন্য ইটের গুড়োও মেশানো হয় বলে প্রায়ই শোনা যায়। বছরখানেক আগে ঢাকার এক মশলা ব্যবসায়ীকে পচা চালের গুড়ো মশলায় মেশানোর দায়ে পুলিশ হাতেনাতে ধরেছিল যা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমরা দেখেছি। বিভিন্ন ধরনের ফলমূল যেমন আম, কলা, পেঁপে, নাসপাতি এবং শাকসবজি যেমন টমেটো, পটল, আলু ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি তাজা রাখতে এবং কৃত্রিম উপায়ে পাকাতে ইথোফেন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড নামক রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদেশ থেকে যে সমস্ত মাছ আমাদের দেশে আমদানি হচ্ছে সেগুলোতেও নাকি ফরমেলাইডিহাইড (ঋড়ৎসধষধফবযুফব) নামক এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঋড়ৎসধষধফবযুফব বা ফরমালিন প্লাস্টিক, পেপার, রঙ, কনস্ট্রাকশন বা মৃতদেহ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। মানবদেহে ক্যান্সার সংক্রমণের বেলায় এই ঋড়ৎসধষধফবযুফব যথেষ্ট সাহায্য করে। লন্ডনে ১৮৯০ সালে এক ল্যাবরেটরি পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী ‘ঊীঢ়ড়ংব ঃড় ঋড়ৎসধষধফবযুফব পড়ঁষফ পধঁংব হধংধষ পধহপবৎ রহ ৎধঃং,’- ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ঊঘঠওজঙঘঊঘঞঅখ চজঙঞঊঈঞওঙঘ অএঅঘঈণ (ঊচঅ)-র রিপোর্টে বলা হয়েছে ‘ঋড়ৎসধষধফবযুফব বীঢ়ড়ংঁৎব রং ধংংড়পরধঃবফ রিঃয পবৎঃধরহ ঃুঢ়বং ড়ভ পধহপবৎ.’ তাছাড়া ২০১৭ সালের ১০ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যশনাল টক্সিকোলজি প্রোগ্রাম’ ফরমালিনকে মানুষের ক্যান্সার রোগ সৃষ্টিতে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে জানায়। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন’ খাদ্যদ্রব্যে ঋড়ৎসধষধফবযুফব বা ফরমালিনের ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
বাংলাদেশেও ফরমালিন ব্যবহার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ফরমালিন মিশানোর অভিযোগে ২০১২ সালের ৯ নভেম্বর নারায়নগঞ্জে চার মৎস্য ব্যবসায়ীকে বিশ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। ভারত সরকারও ২৪ নভেম্বর ২০১২ সালে ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড রেগুলেশন রুলস নামক আইন চালু করার ঘোষণা দিয়েছে। বিশেষ করে মিষ্টি খাদ্যদ্রব্যে কোনও ভেজাল বস্তুর অস্তিত্ব ধরা পড়লে পাঁচল লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা সাত বছরের হাজতবাস এর বিধান চালু করেছে।
অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের চকোলেট, আচার ইত্যাদির প্যকেটে লক্ষ করলে দেখা যায় প্রস্তুতের সময় মাস/বছর লেখা থাকে কিন্তু কবে মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে তা লেখা থাকে না। আবার কোনটিওতে লেখা থাকে তৈরির সময় থেকে ৬ মাস/১২ (অন্তবর্তী সময়) পর্যন্ত ভালো থাকবে কিন্তু প্রস্তুতের সময় লেখাই থাকে না। আর এসব আমাদের ছোট ছোট বাচ্চারা বেশিরভাগ খেয়ে থাকে। এতে তাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতি তো বটেই পেটেরেও বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। নদী বা পুকুরের পানি দিয়ে বরফ, আইসক্রিম বানানো এবং বেকারিগুলোয় মাছির উপদ্রবের মধ্য দিয়ে বিস্কুট তৈরি করার কথা আর নাইবা বললাম। আলোচ্য খাদ্যসমূহ আমাদের স্বাস্থ্যকে মারাত্মক ঝুঁকির দিকে নিচ্ছে তো নিচ্ছে, আয়ুও কমাচ্ছে। আগেরকারদিনে এসব ভেজালের ছড়াছড়ি এত বেশি ছিল না তাই মানুষ ১০০ বছর বা ততোধিক জীবিত থাকতেন। এগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাৎক্ষনিক হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে থাকে এবং শরীরে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দেয় যেমন পেটফোলা, বুকে ব্যথা অনুভব করা, শরীরে জ্বালাপোড়া করা, বমি হওয়া ইত্যাদি। পরবর্তীতে ধরা পড়ে আলসার, পাকস্থলি ও লিভারের সমস্যা, কিডনি বিকল, জন্ডিস ইত্যাদি নানা ধরনের রোগ।
সুতরাং এসব প্রতিরোধে জনসচেতনতা একান্ত প্রয়োজন। গ্রামেগঞ্জে, শহরে-নগরে এ ব্যাপারে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মানুষ তো বাঁচার জন্য খায়, মরার জন্য নয়। আর খাদ্য যদি মরণের কারণ হয়ে দাড়ায় তাহলে তারাই তো এক ধরনের ভাগ্যবান যারা খেতে না পেয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয় (!)।

ষ আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন