মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম
এক সন থেকে আরেক সনে যাওয়ার জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় তাকেই বলে সনের রূপান্তর কৌশল। গবেষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত এ রূপান্তর কৌশল জানা প্রয়োজন। বাংলাদেশে যে কয়টি সন ব্যবহৃত হয় এগুলো আন্তর্জাতিক বিশ্বের অনেকাংশ পূরণ করে থাকে সে কারণে এসব সনের সাথে রূপান্তর কৌশলটি আগে জানা দরকার। খ্রিষ্টিয় সন সারা পৃথিবীতেই চলে। বাংলাদেশ এক সময় ব্রিটিশ উপনিবেশ হওয়ার কারণে সে সময় থেকেই এদেশে খ্রিষ্টিয় সন ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শিক্ষিত লোকজন বাংলা সনের চেয়েও বেশি পরিচিত ও অভ্যস্ত খ্রিষ্টিয় সনে। অন্যদিকে ভারতবর্ষে শত শত বছর যাবৎ মুসলিম শাসন জারি থাকার কারণে সে সময় থেকেই এখানে হিজরি সন ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় উৎসব চাঁদের হিসাবে হওয়ার কারণে এটিও এখানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত। অন্যদিকে প্রাচীন কাল থেকে ভারতবর্ষে শকাব্দ চালু থাকায় এটি এখন সর্বভারতীয় জাতীয় সনের মর্যাদায় অধিষ্টিত। বাংলা সন বাঙালি জাতির জাতীয়তা নির্মাণের এক প্রধান নিয়ামক হিসেবে শুরুর সময় থেকেই একে এদেশের মানুষ মনে প্রাণে গ্রহণ করে নিয়েছে। চলুন এবার বাংলা সনের সাথে এসব সনের রূপান্তর কৌশল নিয়ে কিছু আলোকপাত করা যাক।
খ্রিষ্টিয় সালকে বাংলায় রূপান্তর কৌশল :
হযরত ঈসা আলাইহিস্সাল্লাম খ্রিষ্টান এবং মুসলমান উভয় ধর্মের লোকদের মহামান্য। তাঁর জন্মবর্ষকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এ সনটিকে আরবি ভাষায় বলা হয় ঈসভী, ফার্সি ভাষায় এবং উর্দু ভাষায় বলে ইসভী এমনকি হিন্দি ভাষায়ও এটিকে ঈসভী বলা হয়ে থাকে। তাই বাংলাভাষায়ও এটিকে ঈসায়ী সন ডাকার একটি ধারা প্রাচীন কাল থেকেই চালু আছে। ঈসা আলাইহিস্সাল্লাম খ্রিষ্টান ধর্মের প্রবর্তক অর্থে এ সনকে খ্রিষ্টিয় সনও বলা হয়। বাংলা ভাষায় খ্রিষ্টিয় সন কথাটি বেশি চালু তবে ঈসায়ী সন কথাটিও চালু আছে।
বাংলা এবং খ্রিষ্টিয় বা ঈসায়ী সন উভয়টিই সৌরসন। ফসলি সনের আড়ালে বাংলা সন গণনা শুরু হয় স¤্রাট আকবরের সময় থেকে এবং তখন থেকেই এটি সৌর সনে রূপ নেয়। স¤্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর ৯৬৩ হিজরি তথা ১৫৫৬ ঈসায়ী সনের ওপর ভিত্তি করেই বাংলা সন গণনা প্রবর্তন করা হয়। তবে সনটি ৯৬৩ থেকে গণণা শুরু করা হলেও এর গণনা শুরু করা হয়েছে ১ হিজরি তথা ৬২২ ঈসায়ী সন থেকেই যেটি মূলত হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহেস সাল্লামের হিজরতের স্মারকে শুরু হওয়া হিজরি সনটিই এ সন প্রবর্তনের মূল ভিত্তি। কিন্তু বাংলা সন প্রবর্তন কালে ৬২২ থেকে ৯৬৩ পর্যন্ত অংশটি চান্দ্র মাস ভিত্তিক হিসেবে ছিল। কিন্ত ৯৬৩ হিজরি পরবর্তী অংশটি সৌর সনে রূপান্তর করা হয়। ফলে খ্রিষ্টিয় বা ঈসায়ী সনের সাথে এ সৌর অংশটুকুর রূপান্তর কৌশলটিই এক্ষেত্রে মুখ্য বিষয়। সৌরসনে রূপান্তরিত বাংলা সন চালুর বছর ৯৬৩ হিজরী ছিল ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ। ফলে ১৫৫৬-৯৬৩=৫৯৩ এ সাধারণ ব্যবধানটি সব সময় মনে রাখতে হবে। তবে এ ব্যবধানের শুরুর তারিখটি কত? শুরুর তারিখটি হলো ১১ এপ্রিল ১ বৈশাখ। এ হিসাবটি ১৫৫৬ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত প্রযোজ্য। বাংলা একাডেমি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সংস্কারকৃত বাংলা সন ১৯৮৮ থেকে কার্যকর করায় এ সময় থেকে ১৪ এপ্রিল ১ বৈশাখ ধরে হিসাব করতে হবে। এক্ষেত্রে ১ জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের ১০ পর্যন্ত সময়ে ৫৯৪ এবং ১১ এপ্রিল থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫৯৩ যোগ বিয়োগের বিধান পালন করতে হবে। এবার আমরা ২৬ এপ্রিল, ২০১৬ তারিখ বাংলা বৎসরের হিসাবটি বের করে নেই। যেহেতু ১১ এপ্রিল থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত খ্রিষ্টিয় সনের সাথে ৫৯৩ যোগ করলে বাংলা পাওয়া যাওয়ার কথা তাই ২০১৬-৫৯৩=১৪২৩ পেলাম। ২৬ এপ্রিল ২০১৬তে ১৩ বৈশাখ ১৪২৩ বাংলা সন পাওয়া গেল। আবার ৯ এপ্রিল ২০১৬তে হিসাবটি মিলানোর সময় কিন্তু ৫৯৪ যোগ করতে হবে। কেননা ১ জানুয়ারি থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৯৪ যোগ করার বিধান। ফলে ৯ এপ্রিল ২০১৬ তে বাংলা সন দাঁড়ায় ২০১৬-৫৯৪=১৪২২ বাংলা। খ্রিষ্টিয় সাল থেকে বাংলায় আসার সময় বিয়োগ এবং বাংলা থেকে খ্রিষ্টিয় সালে রূপান্তরের বেলায় যোগ করে করতে হবে। অবশ্য এক্ষেত্রে বাংলা সনের কোন মাস কত দিনে এবং খ্রিষ্টিয় সালের কোন মাস কত দিনে তার সঠিক হিসাব সামনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে উভয় সনের ক্ষেত্রেই সংস্কারকৃত বাংলা সালের নিয়মে একই বছর লিপ ইয়ার হবে। ১৯৮৮ সালের আগের কোন বাংলা সনকে ঈসায়ী সালে রূপান্তরের ক্ষেত্রে ভিন্ন নিয়ম পালন করতে হবে। সেক্ষেত্রে ১ জানুয়ারি থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৯৪ এবং ১৪ এপ্রিল থেকে ৩১ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫৯৩ যোগ বিয়োগ করে বাংলা ও ঈসায়ী সাল বের করতে হবে। এর কারণ হলো ১৯৮৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত সংস্কারপূর্ব বাংলা সনে ১৪ এপ্রিল ছিল ১ বৈশাখ।
বাংলা থেকে হিজরি :
বাংলা সন এবং হিজরি সন কার্যত একই বছর থেকে গণনা শুরু হলেও ৬২২ খ্রিষ্টিয় সনকে ১ হিজরি ধরে ৯৬৩ হিজরি পর্যন্ত গণনায় কোনরকম বেশকম করা হয়নি। ৯৬৩ হিজরি আকবরের সিংহাসন আরোহণের বৎসর বর্যন্ত একে চান্দ্রমাস ভিত্তিক স্থির গণনায় রেখে এর পরের অংশটুকুকে সৌরসনে রূপান্তর করে ফসলি সন প্রবর্তন করা হয়। কালে ফসলি সনই বাংলা সন নামে পরিচিতি পায়। হিজরি সন যেহেতু চান্দ্র মাস ভিত্তিক তাই ২৯ দিন ১২ ঘণ্টায় এর মাস এবং ৩৫৪ দিন ৯ ঘণ্টায় বছর হয়। অন্যদিকে সৌরমাস ভিত্তিক বাংলা সনের মাস হয় ৩০.৪২ দিনে এবং বৎসর হয় ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টায়। ফলে প্রতি বছর ১০/১১ দিন পার্থক্য গড়ে ওঠে। এ পার্থক্য প্রতি ৩৩ বছরে এক বছরের সমান হয়। এবার আমরা ২০২৩ বাংলা সনে হিজরি সন কত বের করব। ১৪২৩-৯৬৩=৪৬০ বৎসর। প্রতি ৩৩ বছরে এক বছরের ব্যবধান হলে ৪৬০ ভাগ ৩৩=১৩.৯৪ অর্থাৎ ১৪ বছর। এবার আমরা ১৪২৩ বাংলা সনের সাথে ১৪ যোগ করলে ১৪৩৭ হিজরী সন পাই যা বর্তমান হিজরি সন।
খ্রিষ্টিয় সাল থেকে হিজরি :
খ্রিষ্টিয় সাল সৌরমাস ভিত্তিক হওয়ায় এর বৎসর হয় ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টায়। চান্দ্র মাসে বৎসর ৩৫৪ দিন ৯ ঘণ্টায়। ফলে খ্রিষ্টিয় সালের সাথে হিজরি সনের বছরে ১০/১১ দিন পার্থক্য গড়ে ওঠে। এভাবে প্রতি ৩৩ বছরে ১ বছরের ৬৬ বছরে ২ বছরের এবং ৯৯ বছরে ৩ বছরের ব্যবধান গড়ে ওঠে। খ্রিষ্টিয় ৬২২ সাল থেকে হিজরি সনের গণনা শুরু হওয়ায় ৬২২ থেকেই হিসাব করতে হবে। প্রথমে খ্রিষ্টিয় সন থেকে ৬২২ বিয়োগ করতে হবে।
২০১৬-৬২২=১৩৯৪ এ বিয়োগফল ১৩৯৪ কে দুটি অংশে ভাগ করা যায় যেমন ১৩ এবং ৯৪ । প্রথমটি অর্থাৎ ১৩ হলো শতাব্দী অংশ আর ৯২ হলো অশতাব্দী অংশ। শতাব্দী অংশকে ৩ দিয়ে গুণ করতে হবে যেমন ১৩ ী ৩=৩৯ এবার অশতাব্দী অংশ থেকে ৩৩ বছরের জন্য ১, ৬৬ বছরের জন্য ২ এবং ৯৯ বছরের জন্য ৩ ফর্মূলা প্রয়োগ করতে হবে। এ নিয়মে ৯৪ এর জন্য ৩ যোগ করি। এখন যোগফল দাঁড়াবে ৩৯+৩=৪২। মোট যোগফল দাঁড়াবে ১৩৯৪+৩৯+৩=১৪৩৬। খ্রিষ্টিয় সাল হতে ৬২২ বিয়োগ করার পর ১০০০ অথবা এর বেশি অবশিষ্ট থাকলে আরো ১ যোগ করতে হবে। এবার যোগফল দাঁড়াল ১৩৯৪+৩৯+৩+১=১৪৩৭ এটিই চলতি হিজরি বর্ষ।
শকাব্দ থেকে খ্রিষ্টিয় ও বাংলা সনে রূপান্তর :
শকাব্দা গণনা শুরু হয়েছে খ্রিষ্টিয় ৭৮ সাল থেকে। এটি প্রাচীন ভারতীয় সন এবং এটি একটি সৌরমাস ভিত্তিক সন। জন্মাবধি এটি খ্রিষ্টিয় সনের সাথে ৭৮ বছরের ব্যবধান থাকায় খ্রিষ্টিয় সাল থেকে ৭৮ বিয়োগ করলেই শকাব্দা পাওয়া যায়। যেমন ২০১৬-৭৮=১৯৩৮ শকাব্দা। ১৫৫৬ খ্রিষ্টিয় সালে বাংলা সন সৌরমাস ভিত্তিক গণনা শুরু হয়। ফলে বাংলা সনের সৌরমাস ভিত্তিক গণনার বছরে শকাব্দা হবে ১৫৫৬-৭৮=১৪৭৮। ফলে বাংলা সনের সাথে শকাব্দার পার্থক্য দাঁড়ায় ১৪৭৮-৯৬৩=৫১৫। অতএব বাংলা সনের সাথে ৫১৫ যোগ দিলেই শকাব্দা পাওয়া যাবে। ১৪২৩ বাংলা সনে শকাব্দা হবে ১৪২৩+৫১৫=১৯৩৮।
অন্যান্য সনের রূপান্তর প্রক্রিয়া :
বিস্তারিত বিবরণ না দিয়ে অন্য কয়টি সনের রূপান্তর প্রক্রিয়া তুলে ধরছি। সম্বৎ: উজ্জয়িনী রাজ বিক্রমাদিত্য প্রবর্তিত অব্দ। খ্রিষ্টিয় সন গণনার ৫৭ বছর আগে প্রবর্তিত। বাংলা সনের সাথে এর পার্থক ৬৫০ বছর। মঘীসন: ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে এ সনের শুরু। বাংলা সন থেকে ৪৫ বাদ দিলে মঘী সন পাওয়া যায়। ত্রিপুরাব্দ : খ্রিষ্টিয় সন থেকে ৫৯০ বাদ দিলে ত্রিপুরাব্দ মিলে। লক্ষণাব্দ : ১১৭৮ খ্রিষ্টিয় সন থেকে লক্ষনাব্দ শুরু। পরগনাতি সন বা সরাইল সন: ১১৯৯ থেকে গণনা শুরু। অমলি সন : বাংলা সনের সাথে মাত্র ৩ বছরের ব্যবধান। বাংলা ৬২২ খ্রিষ্টিয় সালে আর অমলি ৬২৫ সাল থেকে। সনের রূপান্তর প্রক্রিয়া আলোচনায় বরাবরই কোন তারিখ থেকে রূপান্তরটি কার্যকর তা আগে স্মরণে আনতে হয়।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন