মোবারক হোসেন খান
বৈশাখ বাংলা বছরের ষড়ঋতুর প্রথম ঋতু গ্রীষ্মের প্রথম মাস। বৈশাখ বাংলা নববর্ষের মাস। বৈশাখ গরমের মাস। বৈশাখের প্রথম দিন হালখাতার দিন। বৈশাখের প্রথম দিন নববর্ষের শুরুর দিন। বৈশাখের প্রথম দিন থেকে বাঙালিদের নতুন বছরের শুরু। নতুন জীবনের গোড়াপত্তন। বৈশাখের সাথে বাঙালির জীবনের নিবিড় সম্পর্ক। নবান্নের পর মানুষ এই মাসে যেন কর্মকা- জীবনের মাঝে ক্ষণিকের স্তস্তি ফিরে পায়। কাজের চাপ নেই। গোলাতে ধান তোলা হয়ে গেছে। সুতরাং সম্পূর্ণ অবসর জীবন। সন্ধ্যাবেলা গানের আসর বসে। আসরে পালা গান হয়, পুঁথি পাঠ হয়। কখনো যাত্রাগানের আসর বসে। বছরের অন্য কোনো কোনো মাসে যেমন সারা দিনভর ক্ষেতে কাজ করে সময় কাটাতে হয়, বৈশাখে এসে জীবনের ধারা বদলে যায়। সারা দিন কাজ নয়, সন্ধ্যার পর শুরু হয় সে জীবন। উৎসবমুখর জীবন। গান-বাজনায় মেতে ওঠার জীবন। এ জীবনের মাঝেই বাংলাদেশের মানুষ খুঁজে পায় এক নতুন আস্বাদ, নতুন করে জীবন চলার পথের উপাদান, প্রেরণা আর উদ্দীপনা। তাই বাঙালির জীবনে এ মাসের, এ ঋতুতে নেমে আসে এক নব আনন্দধারা। এ ধারায় সিঞ্চিত হয়ে মানুষ নব উদ্যমে পরের মাসগুলোর কর্মমুখর জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
বাংলাদেশ এমনিতে বারো মাস তের পার্বণের দেশ। আর বৈশাখ মাসে যেন উৎসবের ঢল নেমে আসে। মেলা বসে গ্রামে গ্রামে। কোনো কোনো স্থানে এ মেলার নাম বান্নী। কত না বিচিত্র হাতের তৈরি দ্রব্যসম্ভার সেসব মেলা আর বান্নীতে বিক্রি হয়। সেসব জিনিস দেখলে বাঙালি মানুষের জীবনের বৈচিত্র্যময় একটা চিত্র স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে। গ্রামের মেলা যেন গ্রামবাংলার মানুষেরই প্রতিচ্ছবি। তাদের জীবন যেন খ- খ- হয়ে ধরা পড়ে তাদের হাতের কারুকাজে। মাটির পুতুল, পাটের শিকা, তালপাতার পাখা, শোলার পাখি, বাঁশের বাঁশি, ঝিনুকের ঝাড়, পুঁতির মালা, কত না অদ্ভুত সব জিনিসের সমাবেশ ঘটে সে মেলায়। চোখে না দেখলে যেন বিশ্বাসই হয় না বাংলার মানুষের জীবন এত সমৃদ্ধশালী। মানুষ দরিদ্র হতে পারে, দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে তারা জর্জরিত হতে পারে, কিন্তু এসব দুঃখ-কষ্ট তাদের জীবনকে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। গানে-সংগীতে তারা তাদের জীবনকে ভরিয়ে তোলে।
ঋতু পরিক্রমায় শীত পেরিয়ে আসে বসন্ত। আর বসন্ত পার হয়ে আসে গ্রীষ্ম। পৌষ-মাঘের শীত আর ফাল্গুন-চৈত্রের বসন্ত যেন এক হয়ে তাদের জীবন আনন্দ মুখরিত করে তোলে বৈশাখের আগমনে। তাদের জীবনে গতি আসে। নতুন পথপরিক্রমার ইঙ্গিত বয়ে আনে। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ গ্রীষ্মকাল, গরম কাল। কিন্তু গ্রীষ্মের প্রচ- গরম তাদের জীবনকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারে না। তারা গান গায়, তারা আনন্দে নাচে, তারা সংগীতের আসরের আয়োজন করে। তাই বৈশাখ বাংলার মানুষের জীবন, পল্লী মানুষের সঞ্জীবনী শক্তি।
বাংলাদেশে প্রতি মাসেই কোনো না কোনো উৎসব লেগেই আছে। কোনো মাসে আবার একাধিক উৎসব। তাই মাসের হিসাবকেও ডিঙিয়ে গেছে উৎসবে আর উৎসবে। বৈশাখ মাসও তার ব্যতিক্রম নয়। পালা পার্বণের এই দেশে সামাজিক অনুষ্ঠান লেগেই রয়েছে। আর এসব সামাজিক অনুষ্ঠানে নানা ধরনের গান পরিবেশিত হয়ে থাকে। এসব গানে বাংলার মানুষের প্রাণের কথা, মনের ভাষা, অন্তরের আবেদন আর হৃদয়ের আকুলতা অত্যন্ত বাস্তব হয়ে ধরা পড়ে। মাঠের গান, বাটের গান, পল্লী গান বাংলার মানুষের আপন সংস্কৃতি। এতে পল্লী মানুষের সহজ-সরল মনের প্রকাশ। এতে শাস্ত্রীয় সংগীতের জটিলতা নেই। সুরের বক্রগতি নেই। আছে শুধু এক সহজ-সরল আবেদন।
পল্লীগান বা লোকসংগীত বাংলার মানুষের প্রাণ। এ সংগীত চিরায়ত। এ সংগীতে আছে মাটির মানুষের প্রাণের ছোঁয়া। তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাক্সক্ষা, বিরহ-ব্যথা, হাসি-কান্নার কাহিনী এ সংগীতের মূল বিষয়বস্তু। গ্রাম্যজীবন, প্রকৃতি ও পল্লী মানুষের মনের কথা নিয়ে রচিত এই গান। তাই এ গানের সৃষ্টির মুলে রয়েছে কৃষক, জেলে, মাঝি, তাঁতী, কুমার আর কামারের মতো গ্রাম্য মানুষের আর্তি আর হৃদয়ের ভাষা। এ সংগীতের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর এই বৈশিষ্ট্য গ্রাম্য মানুষের একান্ত আপন ধন। যেসব বৈশিষ্ট্য নিয়ে এ সংগীত সমৃদ্ধ সেগুলো হলোÑ এ গানের অনুশীলনের কোনো বিধিব্যবস্থা নেই। স্বভাব দক্ষতাই হলো গায়কের বৈশিষ্ট্য। কেবল কানে শুনেই এ গান লোকের মুখে মুখে প্রচলিত। এ গানের বাণী মুখে মুখে রচিত। কোনো বিশেষ অনুভূতি বা প্রেরণা গ্রাম্য কবিদের স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা আর গান রচনায় উদ্বুদ্ধ করে। তাই এ গানের মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা নেই, কোনো কষ্ট কল্পনা নেই। এ গানের সাথে গ্রাম্য সমাজ জীবনের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের দেশের মানুষের বিচিত্র সামাজিক জীবনের জন্য বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে এ গান বৈচিত্র্যময়। এ গান বিষয়, ভাব, রস আর সুরের দিক দিয়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। মোটকথা, বাংলাদেশের মানুষ যেমন মাটির, এদেশের গানও তেমনি বৈচিত্র্য, মাধুর্য ও ভাবসমৃদ্ধ।
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গ্রীষ্মের খরতাপের বৈশিষ্ট্য গানের মাঝেও প্রতিফলিত। এ ঋতুর গানের বাণীতে গ্রীষ্মের রূপ ফুটে উঠেছে। গ্রীষ্মের রূপ দুভাবে ধরা পড়েছে। একটি তার বহিরঙ্গ দৃশ্যমূর্তি, অপরটি অন্তরঙ্গ ভাবমূর্তি। গ্রীষ্মের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপটি রুক্ষ, কঠোর বিশুদ্ধ ও প্রচ-। প্রখর রোদের প্রচ-তার যেন পৃথিবী জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়। চারদিকে বিরাজ করে এক বিবর্ণ পা-ুরতা। মাঠঘাট প্রান্তর ফেটে চৌচির হয়ে যায়। উত্তপ্ত আবহাওয়া পরিম-লকে অগ্নিময় করে তোলে। চারদিকে যেন নিদাঘের রুদ্রদহন বিরাজ করে। এ যেন প্রকৃতির এক ভীষণ রুদ্ররূপ। যে বছর গতায়ু হয়েছে তার আবর্জনাকে যেন সে সইতে পারে না। তার উষ্ণ নিঃশ্বাসে যা কিছু পুরাতন, যা কিছু জীর্ণ, সবকিছুকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে চায়। এতে যেন রুদ্র সন্ন্যাসীর মহাত্যাগের বাণী নিহিত। মানুষকে আহ্বান করে এক নতুন জীবনের পানে। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে দিতে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে গান লিখেছেন। সে গানের বাণী ও সুরে বৈশাখের কথা বলে, গ্রীষ্ম ঋতুর কথা বলে তিনি লিখেছেনÑ
ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।
একলা রাতের অন্ধকারে আমি চাই পথের আলো।।
দুন্দুভিতে হল রে কার আঘাত শুরু,
বুকের মাঝে উঠল বেজে গুরুগুরু-
পালায় ছুটে সুপ্তি রাতের স্বপ্নে দেখা মন্দ ভালো।
ঋতু গ্রীষ্ম যেন খর রৌদ্রের বন্যা বইয়ে দেয়। তাপিত ধরনী রুদ্র রূপ ধারণ করে। ঝড়ের দাপটে প্রকৃতি হয়ে ওঠে চঞ্চল দিশাহারা। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম গ্রীষ্মকালের সেই কঠোর রূপের বর্ণনা দিয়েছেন তার গানে ও সুরে। তিনি লিখেছেন-
খর রৌদ্রের হোমানল জ্বালি
তপ্ত গগনে জাগি
রুদ্র তাপস সন্ন্যাসী বৈরাগী।
সহসা কখন বৈকালী ঝড়ে
পিঙ্গল মম জটা খুলে পড়ে
‘যোগী শঙ্কর প্রলয়ঙ্কর
জাগে চিত্তে ধেয়ান ভাঙি।’
গ্রীষ্ম ঋতুর রৌদ্রতপ্ত রূপের ভেতরই চুপটি করে বসে আছে নববর্ষ, নতুন বছরের প্রথম দিনটি। বাংলাদেশের ষড়ঋতুর মাঝ দিয়ে একে একে যুগলবন্দীতে বারো মাস শেষ হয়ে আবার ঘুরে আসে। শুরু হয় নতুন বছর। বৈশাখ আসে। আমরা নববর্ষ বলে বরণ করে নিই বৈশাখের প্রথম দিনটিকে। নতুন সবকিছুতেই একটা বৈচিত্র্য থাকে। নতুন বছরের প্রথম দিনটিও তা থেকে বাদ পড়ে। পুরনো বছর গত হয়ে নতুন বছর আসে এক তারুণ্যের বাণী নিয়ে। মহাউল্লাসে নতুন রূপে আমরা বরণ করি এই নববর্ষকে গভীর অনুরাগে। নববর্ষের যে গান সে গান যেন, পুরনো বছরের আবর্জনাকে দূর করার আহ্বান জানায়। বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই যেন সে সুরের অনুরণন শুরু হয়, যা এদেশের মানুষের মনে যাত্রার শুভলগ্ন হয় শুরু। চৈত্র মাসের পাতা ঝরার শেষে বনভূমি নব পত্রপুষ্পদলে সেজে অপরূপ হয়ে ওঠে। নব বিশালয়ের ¯িœন্ধশ্যামল শোভায় দোয়েল, কোয়েল, বউ কথা কও পাখির গানের সাথে পল্লী মানুষের কণ্ঠের সুর এক হয়ে নতুন আনন্দ-সংগীতে দেশকে ভরে তোলে। একটা খুশির উত্তরোল চারদিকে ছোটাছুটি শুরু করে। দেশের মানুষের মনে সৃষ্টি করে এক নতুন ভাবাবেগের। প্রকৃতির নিয়মে পৃথিবী যে আপন নিয়মে পথ-পরিক্রমনে রত সে কথা যেন আবার নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়। নববর্ষের আগমনে চির-পুরাতন কথাটিই সবার মনে জাগ্রত হয়। পহেলা বৈশাখ বিগত বছরের সব দুঃখ-বিষাদের স্মৃতি অন্তর থেকে ধুয়ে মুছে দিয়ে ভাবী সম্ভাবনার এক নতুন দুয়ার উন্মুক্ত করে আমাদের জন্য বয়ে আনে এক আনন্দের পসরা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই বৈশাখের এই রূপের কথা ভেবেই লিখেছেন গান। সুর দিয়েছেন সে গানে। ঋতুচক্রের মতোই সে গান ঘুরে ঘুরে আসে প্রতি বছর। মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার করে। তিনি বৈশাখকে আহ্বান করে লিখেছেনÑ
এসো, এসো এসো, হে বৈশাখ।
তাপস নিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক ॥
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রু বাষ্প সুদূরে মিলাক ॥
বাংলা নববর্ষ তেমনি আবার স্মরণ করিয়ে দেয়, মুঘল স¤্রাট আকরের কথা। তার সিংহাসনে আরোহণের ঘটনা স্মরণীয় হয়ে আছে এই বাংলা নববর্ষের সাথে। এই বাংলা সনের যিনি ¯্রষ্টা তার নাম ফতেহ্উল্লাহ্ শিরাজী। উৎপত্তির সময় থেকে এদেশের মানুষ চাষাবাদ, খাজনা পরিশোধ, সংবছরের হিসাব-নিকাশ সব কিছুতেই বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুসরণ করে থাকে।
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে উৎসবমুখর হয়ে হয়ে ওঠে দেশ। সর্বজনীন উৎসবের মধ্য দিয়ে এক অবিভাজ্য সাংস্কৃতিক রূপ মূর্ত হয়ে ওঠে। পহেলা বৈশাখ এ দেশের মানুষের সামাজিক বিচিত্র অনুষ্ঠানের বিচিত্র সমারোহে জড়িয়ে থাকা প্রকৃতির নব নব অভিষেক। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে কৃষ্ণচূড়ার শাখায় ফুলের রক্তিম উচ্ছ্বাস যেমন এক নতুন সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি তোলে, নববর্ষের আনন্দোচ্ছল দিনও সেই উচ্ছ্বাসের আরেক রূপ। সেই রূপের কথাই কবি লিখেন কবিতায়, গীতিকার লিখেন গানে।
নববর্ষের রূপ-কল্পনায় গানের ভূমিকা তাই বিশেষ তাৎপর্যময়। পুরাতনের সাথে নতুনের যে যোগাযোগ ঘটে মাসের পরিক্রমায়, সেই সুর গানের বাণীতেও হয়ে ওঠে মুখর। এদেশের মানুষের কণ্ঠে নতুন বছরের সে গান বৈশাখের দিনগুলোতে নতুন আশা ও আনন্দের তরঙ্গ বয়ে আনে। তাই নববর্ষ এদেশের মানুষের কাছে চির নতুন। নববর্ষের গান এদেশের মানুষের চিরন্তন রূপ।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, শিল্পকলা একাডেমি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন