‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই/ আজো আমি মাটিতে মুত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি’ (রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ)। কবির মতোই বলতে হচ্ছে ‘কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে বাতাসে নির্বাচনের গন্ধ/ চোখ মেললেই দেখা যায় নির্বাচনী প্রস্তুতির মহোৎসব’। দেশের সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে এগিয়ে চলছে দেশ। নির্বাচনী রোডম্যাপ চূড়ান্ত করার পর নির্বাচন কমিশন অক্টোবরে তফসিল ঘোষণার আগাম বার্তা দিয়েছে। সব মত ও পথের রাজনৈতিক দল প্রার্থী বাছাই করছে; ভোটের কর্মকৌশল-ইসতেহার প্রস্তুত এবং দলীয় নেতাকর্মীদের গণসংযোগ বৃদ্ধির নির্দেশনা দিচ্ছে। এমনকি বড় বড় দলগুলো আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা কমিটি পর্যন্ত গঠন করেছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্বব্যাংকসহ বিদেশী প্রতিনিধি-কূটনীতিক যারাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করছেন তাদের সকলকেই অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করার আশ্বাস দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। এমনকি ‘বিএনপি ভোট করবে’ এই বার্তা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দলীয় নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতির নির্দেশনা দিচ্ছেন।
গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটের অধিকারের ওপর থেকে কালো মেঘ কাটতে শুরু করেছে। রাজনীতিতে একগুয়েমি ও গোয়ার্তুমির বরফ গলতে শুরু করেছে। একপক্ষ্যের নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিহত; অন্যপক্ষ্যের কৌশলে প্রতিপক্ষকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার ফাঁদ তৈরির সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ হচ্ছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর জাতীয় নির্বাচন এবং পরবর্তীতে বিরোধপূর্ণ রাজনীতি চর্চা এবং স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে পাতানো ভোটের খেলা দেখে মানুষ ধরেই নিয়েছিল দেশের জনগণ বোধহয় ভোটের আধিকার হারিয়ে ফেললো। নির্বাচনে ভোট গ্রহণের নামে একের পর এক তামাশা দেশে মানুষ আশাহত হয়। সম্প্রতি সময়ে খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোশেন নির্বাচনে ভোট গ্রহণের নিয়ন্ত্রণ এবং আইন শৃংখলা বাহিনীর প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা দেখে মানুষ ভোটের অধিকারের আশা প্রায়ই ছেড়ে দেয়। এমনকি নির্বাচন পর্যবেক্ষন ও গবেষণাকারী সংগঠন সুজন ৫ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে আশঙ্কা প্রকাশ করে যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতোই নিয়ন্ত্রিত ভোট হতে পারে। তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সুজনের সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, খুলনায় নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হয়েছে। প্রশাসন ও আইন শৃংখলা বাহিনীকে ব্যবহার করে খুলনায় যে নির্বাচনের পরীক্ষা চলেছে গাজীপুরে সেটা ব্যবহার করেছে। এখন ভয় হচ্ছে বাকি তিন সিটি নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচনেও তা করতে পারে। অভিন্ন মত প্রকাশ করেন সুজনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের এই সব আশঙ্কা মেঘ দূর আকাশে উড়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত কয়েক মাসের কথাবার্তা ও দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনায় দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছে যে, শেখ হাসিনা সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের আয়োজনের মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টি করবেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে অনেক নজীর সৃষ্টি করেছেন। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, ভারত, চীন, কানাডাসহ প্রভাবশালী দেশ, দাতা সংস্থাগুলো বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। সে লক্ষ্যে বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্র ও কূটনীতিকরা দীর্ঘদিন থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকরা সরকার, বিরোধী রাজনৈতিক দল, রাজনীতির সব পক্ষ এবং নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এ নিয়ে বহুবার বৈঠক করে প্রস্তাবনা, দিক নির্দেশনা, উপদেশ এবং সহায়তার আশ্বাস দেন। গত সাপ্তাহে বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতরেস। তাঁর সফরটি ছিল হাইপ্রোফাইল। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম ছিলেন তার সঙ্গে। আরো ছিলেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন দেখভাল করেন সে কর্মকর্তাও। বিশেষজ্ঞদের মতে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখতে গুতরেস ঢাকা এলেও নেপথ্যে ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে পর্দার ভিতরে আলোচনা। প্রভাবশালী দেশ আমেরিকা ও চীন সব সময় বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চা এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষ্যে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিল্লী অধিকর্তা ‘কংগ্রেস’ বিতর্কিত ভূমিকা পালন করলেও এখন ভারতের ‘বিজেপি’ চায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। দিল্লী সে বার্তা ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের কিছু সিনিয়র নেতা-মন্ত্রী, বিতর্কিত-হাইব্রীড নেতা ও ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী কিছু বুদ্ধিজীবী নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন এবং বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার ফন্দি করতে সরকারের নীতি নির্ধারকদের প্ররোচিত করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি ওই সব নেতা ও বিতর্কিত ব্যাক্তির তোষামোদী, উপদেশ তোয়াক্কা করছেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে দলীয় নেতাকর্মীদের বার্তা দিয়ে বলেছিলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে প্রতিদ্ব›িদ্বতামূলক, ৫ জানুয়ারীর মতো হবে না। নৌকার প্রার্থীদের যোগ্যতার মাধ্যমে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। জাতীয় কাউন্সিলের পর পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের গণবিচ্ছিন্ন কিছু নেতা, তথাকথিত কিছু সাংস্কৃতি সেবী, উচ্ছিষ্টভোগী বুদ্ধিজীবী-শিক্ষক-পেশাজীবী-এনজিওকর্মী-সচিবালয়ের কিছু দালালচক্র বিগত দিনের মতোই নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের নামে ‘ভোট ভোট খেলার’ মাধ্যমে আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নেয়ার জন্য প্ররোচিত করতে থাকে। এমনকি কৌশলে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্য নানান ফন্দিফিকির, কূটকৌশল-বুদ্ধি-পরামর্শ দেয়। তবে দেশের বুদ্ধিজীবীদের কয়েকজন দীর্ঘদিন থেকে ‘বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করুক’ এমন পরামর্শ দিয়েই যাচ্ছেন। তাদের বক্তব্য হলো ৫ জানুয়ারী পাতানো নির্বাচন করে হলুদ কার্ড পাওয়ার পর আবার নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হলে আন্তর্জাতিক মহল লাল কার্ড দেখাবে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন নিয়ে ঢাকায় কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বøুম বার্নিকাটের উদ্বেগ প্রকাশের পর আওয়ামী লীগের কিছু নেতা হৈচৈ শুরু করেন। তাঁর বক্তব্যকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহিভূত অবিহিত করেন। যদিও ওইসব নেতা ঢাকায় কর্মরত ভারতের হাই কমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার প্রতিটি বক্তব্যে ‘বাহবা’ দিতে অভ্যস্ত। কেউ কেউ বার্নিকাটকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করার আগে আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করার পরামর্শ দেন। কিন্তু বার্নিকাট আওয়ামী লীগ নেতার এই পরামর্শের জুতসই জবাব দেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমাদের উভয় দেশের সংবিধানে এই ধারণা সন্নিবেশিত আছে যে, সকল মানুষ জন্মগতভাবে সমান। তাদের চিন্তা, উদ্ভাবন আর নিজেদের প্রকাশ করার সুযোগ ও স্বাধীনতা দেওয়া হলে অপার সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে।
ফাকা মাঠে গোল দিয়ে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা আবার ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার অঙ্গিকার এবং একের পর এক বক্তব্যে পরিস্কার যে তিনি স্তবকদের কূ-পরামর্শে কর্ণপাত করছেন না। তিনি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। অবশ্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের পর জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি নিরলস সংগ্রাম করেছেন।
ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন রাষ্ট্রদূত রেন্সজে তিরিঙ্ক ৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এ বছরের শেষের দিকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রক্ষমতা ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ থাকার সময় আওয়ামী লীগকে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষায় আন্দোলন করতে হয়েছে। একই দিন সন্ধ্যায় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় কমিটির সভায় তিনি দলের নেতাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, আগামী নির্বাচন হবে চ্যালেঞ্জিং। মনে রাখবেন বিএনপি নির্বাচনে আসবেই। তাই সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সেভাবেই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। দলীয় এমপিদের সতর্ক-নির্দেশনা তিনি বলেন, দলের ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন করুন, যতটুকু দূরত্ব আছে দ্রæতই ঘুচিয়ে ফেলুন। প্রত্যেক এমপি-মন্ত্রীর জরিপ রিপোর্ট আমার কাছে আছে। জরিপ ও তৃণমূলের মূল্যায়নের মাধ্যমে যাকেই মনোনয়ন দেয়া হবে, তার পক্ষেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এখনই এলাকায় গিয়ে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করুণ; আপদে-বিপদে তাদের পাশে দাঁড়ান। ধারণা করছি আগামী অক্টোবরেই নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারে। এর আগে দুপুরে ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকেও শেখ হাসিনা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ হবে উল্লেখ করে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে ছাত্রনেতাদের দিক-নির্দেশনা দেন। বৈঠকে অংশ নেয়া ছাত্রনেতারা জানান, ‘নেত্রী বলেছেন, আগামী নির্বাচন হবে অংশগ্রহণমূলক। এজন্য আমাদের এলাকায় গিয়ে কাজ করতে বলেছেন।’ একই দিন সকালে পিজিআরের অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। যদি বাংলাদেশ জনগণ ভোট দেয়, আল্লাহর ইচ্ছা থাকে, হয়তো আবার সরকার গঠন করবো। আর যদি না হয়, সরকার গঠন করবো না।’ অন্যদিকে বিএনপির নেতারা বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করলেও নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছেন তৃর্ণমূল পর্যায় থেকে। এ জন্যই সিটি কর্পোরেশনে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হচ্ছে বুঝতে পেরেও দলটি মরণকামড় দিয়েই নির্বাচনী মাঠে রয়েছে। আবহাওয়া দেখে মনে হচ্ছে সত্যিকার অর্থেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন