শুল্কহারে বাংলাদেশকে ব্যাপক ছাড় চীন ও ভারতের
শক্তিশালী হচ্ছে আঞ্চলিক অর্থনীতি
ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ব অর্থনীতিতে যে নতুন পোলারাইজেশন শুরু হয়েছে আর ব্যাপক ওলটপালট দেখা দিয়েছে, তাতে এশিয়ায় আঞ্চলিক অর্থনীতিতে নতুন গুরুত্ব ও প্রভাবশালী ভ‚মিকা নিয়ে হাজির হচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আন্তজার্তিক সংবাদ মাধ্যেম সুত্রে জানা গেছে, চলমান বাণিজ্য উত্তেজনায় ইতোমধ্যে নানা সমীকরণ করছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো। অর্থনীতির গতিকে ঠিক রাখতে পারস্পারিক ক্ষোভ ঝেড়ে আঞ্চলিক অর্থনীতির ওপর জোর দিচ্ছে চীন, ভারত ও রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশ। ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির কারণে এসব আঞ্চলিক জোট ও দেশগুলো শক্তিশালী হচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে অনেকটা সুবিধা জনক অবস্থানে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক বৈরিতার মধ্যে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে চীন ও ভারত শুল্কে ব্যপক ছাড় দিয়েছে বলে আন্তজার্তিক গণমাধ্যমের খবরে এসেছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের পণ্যে আমদানি শুল্ক কমিয়েছে চীন। বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের এই পদক্ষেপকে বাংলাদেশের রফতানি খাতের জন্য শুভ মনে করেছেন দেশের ব্যবসায়ীরা।
সম্প্রতি সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, বাংলাদেশ, লাওস ও শ্রীলংকার কিছু পণ্য আমদানিতে চীনের শুল্ক ছাড়ের কথা উঠে আসে। ২০০১ সালে স্বাক্ষরিত এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড এগ্রিমেন্টের আওতায় এই পদক্ষেপ নিয়েছে চীন। এই সিদ্ধান্ত চলতি জুলাই থেকে কার্যকর হবে বলেও জানিয়েছে চীনের সংবাদপত্রটি।
চীনের এ উদ্যোগ বাংলাদেশের রফতানি খাতের জন্য ‘ইতিবাচক’ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। বাংলাদেশের পোশাক খাত চীনসহ আরও কয়েকটি দেশে আগে থেকেই ‘ডিউটি ফ্রি’ সুবিধা পেয়ে থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন ট্যারিফ নীতিতে ইতিবাচক পদক্ষেপ রফতানির সম্ভাবনাকে আরও বাড়াবে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক বিরোধের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বড় অর্থনীতির দেশ। চীনের পণ্যের ওপর ট্যারিফ আরোপের পদক্ষেপ সেই দেশে তেমন প্রভাব না ফেললেও চীনের বাজারে বেশ প্রভাব পড়বে। চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির আকার বেশ বড়। তাই তারা অন্যান্য দেশের সঙ্গে এধরনের পদক্ষেপ নিয়ে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালাবে।
চলতি বছরের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একে অন্যের পণ্যে একের পর এক শুল্ক আরোপ করছে। বেইজিংয়ের ‘মেধাস্বত্ব চুরিকে’ কারণ দেখিয়ে ১৫ জুন ট্রাম্প চীনা পণ্যে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক বসানোর ঘোষণা দেন। ট্রাম্পের এ ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চীনের ওপর আরোপ করা শুল্ক ও তার পরবর্তী পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেবে। ফলে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিটা ভোক্তাদেরই হবে।
এদিকে ট্রাম্পের নীতি বাস্তবায়নের আগেই চীন বাণিজ্য সুরক্ষামূলক এই নীতি বাস্তবায়ন করল। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন সরকার বাংলাদেশসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো থেকে সয়াবিন আমদানির ওপর বিদ্যমান তিন শতাংশ শুল্ক তুলে নিচ্ছে। সয়াখাদ্যের উপর থেকেও বিদ্যমান পাঁচ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার হচ্ছে। এছাড়াও রাসায়নিক দ্রব্য, কৃষিপণ্য, মেডিকেল যন্ত্রাংশ, পোশাক, স্টিল, নন ফেরোস মেটাল, তরল পেট্রোলিয়াম পণ্যে দুই থেকে তিন শতাংশ হারে শুল্ক প্রত্যাহার হবে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, কৃষিপণ্য, রাসায়নিকসহ আরও কিছু পণ্য চীনে রফতানি হয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় তৈরি পোশাক।
পোশাক ব্যবসায়ী ও ডিএসএল গ্রæপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চীনের এই পদক্ষেপের পর বাংলাদেশি পোশাক ব্যবসায়ীরা সেই দেশে আরও বড় বাজার ধরার চেষ্টা করবেন। তবে এতে করে সামগ্রিকভাবে শিল্পের ব্যাপ্তি বাড়বে না। আরও নতুন কারখানা চালু ও নতুন বিনিয়োগ না হলে পোশাক খাত কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে না।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ বিশ্বের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা থাকলেও জাহাঙ্গীর মনে করছেন, দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের জন্য আমদানি শুল্ক কমানোর চীনের এই পদক্ষেপে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সুফল পাবেন।
এদিকে চীনের পরই বাংলাদেশসহ পাঁচ দেশের জন্য তিন হাজার ১৪২ পণ্যে শুল্ক ছাড় দিয়েছে ভারত। এশিয়া প্যাসিফি ট্রেড এগ্রিমেন্টের (আপটা) আওতায় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে এ সুবিধা দিল দেশটি। চলতি জুলাই থেকে এ সুবিধা কার্যকর করেছে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটি। সম্প্রতি ভারতের দ্য হিন্দু বিজনেস অনলাইনের এক খবরে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশের পাশাপাশি চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলংকা ও লাওস পাবে এ সুবিধা। আর এলডিসিভুক্ত বাংলাদেশ ও লাওসকে ভারত ৪৮ ট্যারিফ লাইনে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। তবে আগে থেকে বাংলাদেশ সাফটার আওতায় তামাক ও মদজাতীয় ২৫ পণ্য বাদে সকল পণ্যে ভারতে রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। তৈরি পোশাকের ৪৬টি ক্যাটাগরিও এর মধ্যে রয়েছে।
এদিকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চীন যুক্তরাষ্ট্রের তুলায় বাড়তি শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের তুলা ক্রয়ে বাংলাদেশ কিছু সুবিধা পেতে পারে। কিন্ত মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে এ ধরণের বাণিজ্য যুদ্ধে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা অন্যরাও প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে। ফলে একের পর এক প্রতিরক্ষণ দেয়াল তৈরি হবে। এর সঙ্গে আরো নতুন নতুন দেশ যুক্ত হতে পারে। ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যের গতি শ্লথ যাবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশে^র বৃহত্তম তুলা রফতানিকারক দেশ। চীন ২৫ শতাংশ তুলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করে। সেদেশ থেকে প্রতিবছর ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি তুলা আমদানি করে চীন। কিন্ত বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তুলার দামে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
আন্তজার্তিক তুলা বাজারের তথ্যনুযায়ী, তুলা আমদানিতে বিশে^র বৃহত্তম দেশ হলো বাংলাদেশ। প্রতিবছর বাংলাদেশ তিন বিলিয়ন তুলা আমদানি করে। যার মধ্যে ১০ শতাংশ আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কটন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মেহেদী আলী ইনকিলাবকে বলেন, বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে আমরা বিভিন্ন পণ্যে সুবিধা পেতে পারি। যা আমাদের দেশের ব্যবসা বাণিজ্যে সুফল বয়ে আনবে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চীনের বিরুদ্ধে হুশিয়ারির পর তুলার দাম কিছুটা কমলেও এখন আবার তা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তাই তুলা আমদানিতে বাংলাদেশ খুব একটা লাভবান হবে বলে মনে করেন না তিনি।
দেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, বাণিজ্য যুদ্ধে আমরা সুবিধাও পেতে পারি আবার ক্ষতিতেও পড়তে পারি। এখনও সুনির্দিষ্ট ধারণা পাইনি। এ জন্য আরও কিছুদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এক্সপোর্টাস এসোশিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি এবং বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী ইনকিলাবকে বলেন, যে কোন ট্যারিফ সুবিধাই আমাদের জন্য ভালো। বর্তমান বাণিজ্য যুদ্ধ আমাদের রফতানিমুখী শিল্পের জন্য আর্শীবাদ হয়ে দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, এ ধরণের সুবিধা পেলে রফতানিমুখী শিল্পে গতিশীলতা আসে। তবে এখানে নানা চ্যালেঞ্জও রয়েছে। অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে আমরা অনেক পিছেয়ে। কারণ প্রতিযোগী দেশগুলো আন্তর্জাতিক নীতি অনুসরণ করে দ্রæত তা সমন্বয় করে, যেটা আমরা করতে পারি না। তাই আমরা অনেক পিছিয়ে। ট্যারিফ সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা কাজে লাগাতে সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।
বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষতি করতে শুরু করেছে বাণিজ্য উত্তেজনা : ডবিøউটিও
গত বুধবার এক বিবৃতিতে ডবিøউটিওর মহাপরিচালক রবার্তো আজেভেদো বলেছেন, বাণিজ্য উত্তেজনা সব দেশের প্রবৃদ্ধি ও পুনরুদ্ধারের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে উঠেছে। আমরা এরই মধ্যে বেশকিছু সূচকে এর প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। বিবৃতিতে আজেভেদো বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতার প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাননি। তবে মে মাসে ডবিøউটিওর ত্রৈমাসিক বাণিজ্য পূর্বাভাস সূচকে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে মন্থর প্রবৃদ্ধির আভাস দেয়া হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন