আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সময়মতো নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকার ব্যর্থ বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরী। গত বুধবার ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৫’র বাংলাদেশ অংশ নিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেছেন। জন কেরী বলেছেন, আইন-শৃংখলা বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত নিপীড়ন ও হত্যার ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশ সরকার ‘সীমিত পদক্ষেপ’ নিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। উল্লেখ করা যেতে পারে, মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৫’র বাংলাদেশ অংশে বিচারবহির্র্ভূত হত্যাকা-, গুম, ব্লগার খুন, গণমাধ্যমের উপর বিধি-নিষেধ, বাল্যবিবাহ, জোরপূর্বক বিবাহ, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, শ্রম ক্ষেত্রে নিম্নমানের কর্মপরিবেশ ইত্যাদিকে সবচেয়ে মারাত্মক সংকট বলে অভিহিত করা হয়েছে। আইন-শৃংখলা বাহিনীর নির্যাতন, নিপীড়ন, বিধিবহির্ভূত গ্রেফতার, দুর্বল বিচারিক ক্ষমতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব এবং বিচারকার্যে বিলম্বকে মানবাধিকার বাস্তবায়নে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, আইনের শাসনের দুর্বলতা শুধু ব্যক্তি ও সরকারী কর্মচারীদেরই মানবাধিকার লংঘনে উৎসাহিত করে না, এটা নাগরিক অধিকারকে ও খর্ব করে। এছাড়া রাজনৈতিক ও দলীয় কারণে সহিংসতাও মারাত্মক উদ্বেগের কারণ।
দেশের আইন-শৃংখলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। তা উপলব্ধি করার জন্য কোনো দেশ ও সংস্থার এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পড়ার তেমন কোনো আবশ্যকতা আছে বলে মনে হয় না। বিদ্যমান বাস্তবতা, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরাদি এবং নাগরিকদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট। মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক মার্কিন প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে তাতে দ্বিমত প্রকাশের কোনো অবকাশ নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে বস্তুত একই কথা উঠে এসেছে। আমরাও বিভিন্ন সময় বলেছি, নাগরিক নিরাপত্তা ও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং দিনকে দিন এর অবনতি ঘটছে। কে না জানে, নাগরিক নিরাপত্তা ও আইন-শৃংখলা সুরক্ষার দায়িত্ব আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর। অথচ এই বাহিনী ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। নাগরিক নিরাপত্তা বলতে যা বুঝায়, তা নেই। আইন-শৃংখলা ভঙ্গুর, ক্রমাবনতিশীল এবং নিয়ন্ত্রণহীন। এ অবস্থায় সন্ত্রাসী-দুষ্কৃতীচক্রগুলো বেপরোয়া এবং তাদের ভয়ে মানুষ ভীত ও সন্ত্রস্ত। তাদের দমন-নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃংখলা বাহিনী লাগাতার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। সবচেয়ে বিচলন ও উদ্বেগের বিষয় হলো, আইন-শৃংখলা বাহিনীর এক শ্রেণীর সদস্য সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতীদের মতো গুম, খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি, চাঁদাবাজি, রাহাজানি, শ্লীলতাহানি ইত্যাদির মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। গোটা বাহিনীকে তারা আতঙ্ককর বাহিনীতে পরিণত করেছে। বিধি-বহির্ভূত গ্রেফতার, হয়রানি ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, কথিত ক্রসফায়ার ইত্যাদি এতটাই বেড়ে গেছে যে, মানুষ কার্যত নিরালম্ব ও অসহায় হয়ে পড়েছে। আইন-শৃংখলা বাহিনীর বেপরোয়া সদস্যদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও যেন সরকার হারিয়ে ফেলেছে। এ পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার তার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য আইন-শৃংখলা বাহিনীর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তার জন্য একে এক ধরনের অভয়, দায়মুক্তি দিয়েছে। এই সুযোগটি বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্য গ্রহণ করছে। তারা আরো মনে করেন, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীতে ব্যাপক দলীয়করণ হয়েছে যাতে এই বাহিনীর অনেকের চরিত্র ও আচরণে দলীয় ভাবধারার ব্যাপক অনুপ্রবেশ করেছে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে এই বাহিনী তার মূল দায়িত্ব পালন থেকে লক্ষণীয়ভাবে সরে এসেছে বলেও তারা মনে করেন।
যখন কোনো দেশে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নাগরিক নিরাপত্তা ও আইন-শৃংখলা সুরক্ষায় ব্যর্থতার পরিচয় দেয়, সরকার আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যথাযথভাবে ব্যবহার ও কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন সন্ত্রাসী-দুষ্কৃতীচক্র এবং উগ্রপন্থী-চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো ঘোলাপানিতে মাছ শিকারে উন্মুখ হয়ে পড়ে। আমরা আমাদের দেশেও সেরকম লক্ষণই দেখতে পাচ্ছি। দেশী-বিদেশী চরমপন্থী-উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো যে এখন যথেষ্টই সক্রিয় ও তৎপর ঘটনাপ্রবাহদৃষ্টে সে রকমই প্রতীয়মান হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক দুঃসাহসিক হামলা ও খুনের ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা, ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের খুন, ব্লগার খুন ক্রমাগত বাড়ছে। এসব হামলা ও হত্যাকা-ের দায় নিতে দেখা যাচ্ছে আইএসসহ বিভিন্ন চরমপন্থী সংগঠনের। এই পরিস্থিতিতে মানুষই নয়, দেশ ও দেশের স্বার্থও হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা হচ্ছে। সাম্প্রতিক দু’টি খবর অনেকেরই নজরে এসেছে। এর একটি খবরে বলা হয়েছে, আইএস বাংলাদেশে ঘাঁটি করতে চাচ্ছে ভারত ও মিয়ানমারে হামলা চালানোর জন্য। অপর খবরে বলা হয়েছে, আসামের বিছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা বাংলাদেশের প্রধান গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডে নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা করছে। আইএস সংক্রান্ত এ ধরনের খবর আগেও প্রকাশিত হয়েছে। উলফা সংক্রান্ত একই ধরনের খবরও আগে পাওয়া গেছে। তবে এবারের খবরের ব্যাপারে প্রতিবাদ করেছেন উলফা নেতা পরেশ বড়–য়া। বলেছেন, খবরটি ভিত্তিহীন এবং উলফার বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে নাশকতা চালানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। তিনি বলেছেন, ‘ভারতীয় গোয়েন্দারা আমাদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’ আমরা এখনো বিশ্বাস করি না, এদেশে আইএস’র কোনো উপস্থিতি বা তৎপরতা আছে এবং এমন বিশ্বাসও আমাদের নেই যে, উলফা এখানে কোনো নাশকতা চালাতে পারে। কিন্তু বিশ্বাসই সব নয়। বিশ্বাসের বাইরেও ঘটনা ঘটতে পারে। কাজেই খবর দু’টি একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাছাড়া তাদের নামে অন্য কোনো পক্ষও ঘটনা ঘটাতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট সতর্ক ও সাবধান হওয়া দরকার। সব কিছু গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। আশংকার এহেন প্রেক্ষাপটে আমাদের নাগরিক নিরাপত্তা ও আইন-শৃংখলা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। বিকল্প নেই অপশাসন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার। বিকল্প নেই মানুষের মানবাধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, শান্তিপূর্ণ ও সহাবস্থানমূলক রাজনীতি চর্চা তথা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ, বিদ্বৎসমাজ একযোগে এদিকে নজর দেবে, এটাই আমরা একান্তভাবে প্রত্যাশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন