শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

‘আমি গোলাম সারওয়ার বলছি’

সাকির আহমদ | প্রকাশের সময় : ১৫ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন সাংবাদিকতা জগতের নক্ষত্র নিয়ে কথা বলতেন। এখনো বলেন। যারা চলে গেছেন তাদের সম্পর্কে তিনি কতটা উচুঁ ধারণা পোষণ করেন সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। মাওলানা আকরম খাঁ ও তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার নাম উচ্চারণ করে বলতেন, এই দু’জনের প্রতিচ্ছবি দেশ ও জাতি কোনো দিন পাবে না। তবে তাদের পরশ যারা পেয়েছেন তারাই জ¦লে উঠেছেন। এই ইতিহাস স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ের।
স্বাধীনতা পরবর্তী সাংবাদিকতায় দিকপাল হিসাবে যাদের নাম প্রথমেই আসে তাদেরই একজন হলেন গোলাম সারওয়ার। দিকপালের তালিকায় জহুর হুসেন চৌধুরী, এবিএম মুসা, হাবিবুর রহমান মিলন, গিয়াস কামাল চৌধুরী, নির্মল সেন, কেজি মোস্তফা, আহমেদ হুমায়ুন, আতাউস সামাদ, শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন। এদের সবার সঙ্গেই গোলাম সারওয়ার ভাইয়ের ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল।
এসব কথা বলার কারণ একটাই। আর সেটি হচ্ছে ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন সংবাদপত্র জগতে বিশেষ প্রতিবেদন শব্দের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন। তিনি ইনকিলাবের সাংবাদিকদের বিশেষ প্রতিবেদন লেখার বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়েই বসে থাকতেন তা কিন্তু নয়। বলতেন গোলাম সারওয়ার কিভাবে কাজ করেন সেটি ভালো করে দেখুন।
আমি ভাবতাম কবে সেই উজ্জল নক্ষত্রের দেখা পাবো। জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রায়ই সারওয়ার ভাইয়ের চেহারা দেখতাম। সত্যি বলতে ১৯৮৬ সালের ১০ এপ্রিলে ইনকিলাবে রিপোর্টার হিসাবে কাজ শুরু করি। জুনিয়র থেকে সিনিয়র হওয়ার পরও সারওয়ার ভাইয়ের মতো এতো বিশাল মাপের সাংবাদিকের মুখোমুখি দাঁড়ানোর কথাও চিন্তা করিনি।
১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় গোলাম সারওয়ার ভাইয়ের সান্নিধ্য পাই প্রথম। জাতীয় প্রেসক্লাবে বসেই কোথায় কি ঘটেছে? ঘটনার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে? এসব প্রশ্ন করতেন। এভাবেই এক বড় দিকপালের কাছাকাছি চলে যাই। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘সাকির ইনকিলাবে তোমার বিশেষ রিপোর্ট পড়েছি। আমার মনে হয় আরেকটু যতœ নিলে আরো ভালে হতো’। এমন কথাতেই কাজের প্রতি স্পিরিট বেড়ে যেতো। এমনও হয়েছে, মেয়েকে ভিকারুননূন নিসা স্কুলে দিয়ে প্রেসক্লাবে গিয়ে বসে পত্রিকা পড়ছি। হঠাৎ গোলাম সারওয়ার ভাইয়ের কণ্ঠ, ‘সাকির কেমন আছো? তোমার মেয়েটা ভালো তো?’
গোলাম সারওয়ার ভাই ক্রাইম নিয়ে বিশেষ রিপোর্ট লেখার বিষয়ে মাঝে মধ্যে টিপস দিতেন। বলতেন, ‘আমার মনে হয় এই বিষয়ের ওপর রিপোর্ট করা দরকার’। আমার ছুটে চলার পথেই একদিন সারওয়ার ভাই বললেন, ‘সাকির তুমি কি আমার সাথে কাজ করবে?’ আমার মুখে ছিল না কোনো জবাব। শুধু চেয়ে দেখেছিলাম ওই মুখটা।
তারপর একদিন শেষ বিকালে বাসায় ফোন করে সারওয়ার ভাই বললেন, ‘সাকির সন্ধ্যার দিকে ইত্তেফাকে চলে এসো’। সন্ধ্যার দিকে গিয়ে দেখা করার পর তিনি আমার হাতে তুলে দিলেন ইত্তেফাকে সিনিয়র রিপোর্টার হিসাবে যোগদান করার নিয়োগপত্র। মাত্র একটি বছর সারওয়ার ভাইয়ের সান্নিধ্যে থেকে ইত্তেফাকে কাজ করেছি। তিনি ইত্তেফাক ছেড়ে চলে যাবার সময় পদত্যাগপত্র লিখে নিজেই আমাদেরকে পড়ে শোনালেন।
পদত্যাগপত্র হলেও শব্দের মেলায় ছিল ইত্তেফাক নিয়ে অতীত ও আগামীর স্বপ্ন। শেষ কর্মদিবসের রাতে অফিস থেকে বের হওয়ার সময় সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। আর বলে গেলেন, তোমরা মনে করবে না আমি চলে যাচ্ছি। আমি তোমাদের মাঝেই বেঁচে থাকতে চাই। আমি আছি এবং আমি থাকবো। ইত্তেফাক ছেড়ে গোলাম সারওয়ার সংবাদপত্র জগতে যুগান্তর ও সমকাল জন্ম দিলেন। একজন সফল বার্তা সম্পাদক কি করে জনপ্রিয় সম্পাদক হতে পারেন তার একমাত্রও দৃষ্টান্ত হলেন গোলাম সারওয়ার।
আসলেই তিনি ইত্তেফাক ছেড়ে যাননি। জাতীয় প্রেসক্লাবে দেখা হলেই জানতে চাইতেন কে কেমন আছে। সব সময় সবার খোঁজ রাখতেন। ফোন করে বলতেন, আমি গোলাম সারওয়ার বলছি। আজকের এই লেখায় আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমার সাংবাদিকতা জীবনের ওই একটি বছর ছিল সত্যিই কানায় কানায় ভরপুর। শুধু আমি কেন আর কেউই কোনো দিন ফোনের অপর প্রান্ত থেকে শুনতে পাবে না ‘আমি গোলাম সারওয়ার বলছি’।
মৃত্যু কাউকেই ছাড়বে না। সবার সঙ্গেই আলিঙ্গন করবে মৃত্যু নামের শব্দটি। কিন্তু কোনো কোনো মৃত্যু বড় ধরনের ক্ষতি বয়ে আনে। সাংবাদিকতার দিকপালের চলে যাবার তালিকা দীর্ঘ হলো প্রথিতযশা সাংবাদিক গোলাম সারওয়ারে নাম যুক্ত হয়ে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন