প্রাচীন মিশরে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেশীয় রাজা মেনেসের নেতৃত্বে ফারাও রাজবংশের সূচনা। প্রাচীন মিশরীয় স¤্রা্রটের রাজকীয় উপাধি ফারাও বা ফিরাউন। প্রচলিত ফিরাউন বলতে দ্বিতীয় রামসিসকে (১২৭৯ থেকে ১২১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বোঝায়। ফিরাউন ১৮তম রাজবংশের তৃতীয় শাসক। ফিরাউনের অপর নাম কাবুস। তাফসির ইবনু কাসিরে ফিরাউনের পূর্ণ নাম বলা হয়েছে, ওয়ালিদ ইবনু মুসাইয়্যিব ইবনু রাইয়্যান। প্রাচীন মিশরের রাজধানী পেন্টাটিউক। নীল নদ তীরবর্তী এ নগরীই ছিল ফিরাউনের আবাসস্থল। সে ছিল কুখ্যাত শাসক। এ পাপিষ্ঠের নাম পবিত্র কুরাআনের ২৭টি সুরায় ৭৪ বার পাওয়া যায়।
একদা ফিরাউন দুঃস্বপ্ন দেখে অস্থির হয়ে ওঠে। স্বপ্নের ব্যাখ্যাকারীর মাধ্যমে ফিরাউন জানতে পারে, বানি ইসরাইল গোত্রে জন্মগ্রহণকারী এক পুত্র সন্তানের নেতৃত্বে ফিরাউনের রাজত্বের অবসান ঘটবে। তখন ফিরাউন গুপ্তচর লাগিয়ে দেয় যেভাবেই হোক, যেন বানি ইসরাইল গোত্রে কোনো পুত্র শিশুর জন্ম না হয়। পবিত্র কুরআনের ভাষায়, ‘ফিরাউন পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল এবং সে তার জনগণকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল। তাদের এক শ্রেণিকে সে অত্যন্ত দুর্বল করে রেখেছিল, যাদের পুত্র সন্তানকে সে জবাই করত ও নারীদেরকে (ভোগের জন্য) জীবিত রাখত। প্রকৃতপক্ষেই সে ছিল মহা বিপর্যয়সৃষ্টিকারী’ (কাসস: ০৪)। এমনি বৈরী পরিবেশে হযরত মুসার (আ.) এর জন্ম হয়। অলৌকিকভাবে ফিরাউনের রাজপ্রসাদে, রাজকীয় সুবিধায় তিনি বড় হন।
ফিরাউন নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপালক ঘোষণা করে। পবিত্র কুরআনের ভাষায়, ‘সে বলল, আমি-ই তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিপালক বা রব। পরিণামে সে আল্লাহ্র ইহ-পারলৌকিক শাস্তিতে নিপতিত হলো। নিশ্চয়ই এর মধ্যে রয়েছে ধর্মভীরুদের জন্য চরম শিক্ষা’ (নাযিয়াত: ২৪-২৬)।
ফিরআউন জনগণের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। একত্ববাদে বিশ্বাসী হযরত মুসা (আ.) এর অনুসারীদের ফিরাউন সমূলে ধ্বংসের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। ফিরাউন ছয় হাজার সৈন্য নিয়ে মুসা (আ.) এর অনুসারীদের তাড়া করে লোহিত সাগর তীরে নিয়ে আসে। মুসা (আ.) এর অনুসারীরা বলতে থাকে ‘আমরা তো ধরাই পড়ে গেলাম...’। তখনই মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ফিরাউনের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা হলো: ‘সুতরাং আমি তাকে ও তার বাহিনীকে ধরলাম এবং তাদের সাগরে নিক্ষেপ করলাম’ (কাসাস: ৪০)।
নিরুপায় ফিরাউনের অত্যন্ত নাজুক, নির্মমভাবে পতন হলো। মুসা (আ.) এর দুর্বল, অসহায় অনুসারীরা পেল শান্তি ও মুক্তি। মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘আমি বানি ইসরাইলকে সাগর পার করিয়ে দিলাম। তখন ফিরাউন ও তার বাহিনী অত্যাচার ও সীমালংঘনের উদ্দেশ্যে, তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। তারপর যখন সে ডুবে মরার উপক্রম হলো, তখন বলতে লাগলো: ‘আমি স্বীকার করলাম, বানি ইসরাইল যে আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আমি অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত’। (আল্লাহ্র পক্ষ থেকে উত্তর দেওয়া হলো) ‘এখন ঈমান আনছ? অথচ এর আগে তো তুমি অবাধ্যতা করেছ এবং তুমি অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে’ (ইউনুস: ৯৯, ৯১)।
১৮৮১ সালে মিশরের এক নদীর উপত্যকায় (পাহাড়ের মাঝখানে, যেখান দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়েছে) ফিরাউনের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের অভিমত, তখন ঐ মৃতদেহের বয়স প্রায় ৩০০০ বছর। অবিকৃত ঐ লাশটি তখন পর্যন্ত মমি করা হয়নি। ১৮৮১ মতান্তরে ১৮৯৮ সালে মমি করে ফিরাউনের লাশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। নীল নদের ৪০০-৫০০শ গজ দূরে তাহরির জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে ফিরাউনের মমি। স্থানটি বর্তমান মিশরের রাজধানী কায়রো সংলগ্ন। ৩১২০ বছরের বেশি সময়কাল যাবৎ ফিরাউনের লাশ সংরক্ষিত থাকার মধ্যেও কুরআনের সত্যতার প্রমাণ মিলে ‘আজ আমি তোমার দেহকে সংরক্ষণ করবো, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীকালের মানুষের জন্য নিদর্শন হয়ে থাকো। কেননা, আমার নিদর্শন সম্পর্কে অসংখ্য লোক নিতান্তই অসচেতন’ (ইউনুস: ৯২)।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন