পরিবার, স্বজন, সহপাঠীসহ দেশবাসীর দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে ৪২ জনকে জামিনে মুক্তি দিয়েছেন আদালত। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর বিভিন্ন থানা এলাকা থেকে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গতকাল নগরীর ৯ থানার পৃথক মামলায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হকিম আদালত থেকে এসব জামিন দেওয়া হয়।
আন্দোলনকারী অনেকের জামিন হতে পারে এমন প্রত্যাশায় গতকাল সকাল থেকে আদালত এলাকায় জরো হতে শুরু করেন পরিবার, স্বজন ও সহপাঠীরা। অবস্থা পর্যবেক্ষণে সদরঘাট এলাকার নিম্ম আদালত প্রাঙ্গনে আসেন রাষ্ট্রের অনেক প্রথিতযশা বিজ্ঞ আইনজীবী ও বিশিষ্টজনরা। শিক্ষাথীদের জামিন আবেদন মঞ্জুর করায় বিচারকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এ সব বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। সন্তানদের মুক্তির সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে পুরো আদালত এলাকায় উল্লাশ ছড়িয়ে পড়ে। আনন্দ অশ্রুতে নিজেদের সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলে স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়লেন স্বজনরা।
গতকাল সকাল থেকেই জামিনের আবেদন করা শিক্ষার্থীদের বাবা-মা, ভাই-বোন আদালত চত্বরে ভিড় করতে শুরু করেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শিক্ষার্থীদের পক্ষে জামিন শুনানী শুরু হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে একে একে বিকেল ৩টার পরে শুনানী শেষ হয়। শিক্ষার্থীদের জামিন দেওয়া বিচারকরা হলেন, ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম মো. সাইফুজ্জামান হিরো, অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম কেশব রায় চৌধুরী, আসাদুজ্জামান নূর, মহানগর হাকিম কারী কামরুল ইসলাম, মো. সারাফুজ্জামান আনছারী, এ, কে, এম, মঈন উদ্দিন সিদ্দিকী, সাদবীর ইয়াছির আহসান চৌধুরী ও ঢাকার শিশু আদালতের বিচারক আল মামুন। এ দিকে জামিন হওয়ায় পর শিক্ষার্থীদের পরিবার ও স্বজনরা সন্তানদের আনতে ঢাকার কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের অভিমুখে যাত্রা করেন।
আদালত সূত্র জানায়, শিক্ষার্থীদের জামিনের কাগজপত্র কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর আগে কারাবন্দী শিক্ষার্থীদের জামিনের বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে আদালতে হাজির হয় সুপ্রিম কোর্টের জৈষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। পরে তারা সাংবাদিকদের জানান, আমারা জামিন দেওয়া বিচারকদেরসহ এই আদালতের সকল বিচারককে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিচারকদের এই আদেশের ফলে ন্যায় বিচার পেতে শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা।
পুলিশ সূত্র জানায়, আন্দোলনের সময় সংঘাত, ভাঙচুর, উসকানি ও পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ এ পর্যন্ত ৫১টি মামলায় ৯৯ জনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের মধ্যে ৫২ জন শিক্ষার্থী। গতকাল ঢাকার আদালতে পৃথকভাবে ৪২ শিক্ষার্থীর পক্ষে জামিনের আবেদন করা হয়। জামিন পাওয়া শিক্ষার্থীরা হলো বাড্ডা থানার মামলায়- মুশফিকুর রহমান, ইফতেখার আহম্মেদ, নুর মোহাম্মদ, জাহিদুল হক, হাসান, রিদওয়ান আহম্মেদ, তারিকুল ইসলাম, এএইচএম খালিদ রেজা, রেজা রিফাত, রাশেদুল ইসলাম, সীমান্ত, ইকতেদার। ভাটারা থানার মামলায়- মাসহাদ মর্তুজা বিন আহাদ, সাখাওয়াত হোসেন নিঝুম, শিহাব শাহরিয়ার, আজিজুল করিম অন্তর, ফয়েজ আহম্মেদ আদনান, মেহেদী হাসান। উত্তরা পশ্চিম থানার মামলায়- মাহবুব খান রবিন, তোফায়েল, আশিক। কোতয়ালী থানার মামলায় মেহেদী, জাহিদুল, দুলাল। নিউমার্কেট থানার মামলায়- মো. আজিজর, আমিন, নূর আলম। শাহবাগ থানার মামলায়- আবু বক্কর সিদ্দিক, রিয়াজুল হক ওরফে উলু হাজী। ধানমন্ডি থানার মামলায়- সোহাদ খান, মাসরিকুল আলম, তমাল সামাদ, মাহবুবুর রহমান, ওমর সিয়াম, মো. ইকবাল হোসেন, নাইমুর রহমান, মিনহাজুল ইসলাম। পল্টন থানার মামলায়- সাইফুল ওয়াদুদ ও রমনা থানার মামলায় আরমানুল হক, খাইরুল আলম দিপু, দাইয়ান নাফিজ প্রধান। মামলা সূত্রে জানা গেছে, গত ২৯ জুলাই রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হন। এরপর ঘাতক বাসচালকের শাস্তি এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা।
গতকাল আদালত এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, আদালত থেকে যখন একে একে শিক্ষার্থীদের জামিন মঞ্জুর করা হচ্ছিল তখন উপস্থিত পরিবার ও স্বজনরা সন্তানের মুক্তিকে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। উপস্থিত অভিভাবকরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে নিজেদের কান্নায় ভাসিয়ে দেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সেই কান্না ছিল আনন্দের। অনেক আইনি লড়াই শেষে বুকের মানিকরা ফিরে যাবে ঘরে। মায়ের শাড়ীর আচলে মাথা রেখে ঈদ কাটাবে স্ব্জনদের সঙ্গে। বুকের ধন কারাগারের চার দেয়ালে বন্দী থাকার কী যে কষ্ট তা চোখের জলেই ঝেড়ে দিয়েছিলেন অভিভাবকরা।
জাহিদ হক নামে এক নামে সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মুক্তির পর আনন্দে উল্লসিত হয়ে পড়েন তার স্বজনরা। এ সময় তাদের সবার চোখ কান্নায় ছল ছল করতে থাকে। তারা একে অপরকে বুকে ঝড়িয়ে অনেক বড় বোঝা ঝেড়ে ফেলে নিজেদের হালকা করেন।
ধানমন্ডির একটি মামলায় দুই ভাই মাহমুদুর রহমান ও মাহবুবুর রহমান গ্রেফতার হয়েছিলেন। মাহমুদ ইউল্যাবে আর মাহবুব বিএফ শাহীন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে এখন আইইএলটিএস করছেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এই দুই সন্তানের জামিন হওয়ার খবর শুনে তাঁদের মা চিৎকার করে ওঠেন। ‘আমার ছেলেদের জামিন হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ।’ বলে ওই নারী স্বজনদের দিকে দৌড়ে যান।
একইভাবে বাড্ডার মামলায় গ্রেফতার মেহেদী হাসানের জামিনের সংবাদ শুনে তাঁর বাবা এম এ মাসুদ খান আদালতের বারান্দায় কান্নায় ভেঙে পড়েন। এই বাবা বলেন, ‘আজ আমার আনন্দের দিন। ছেলে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে কত যে যন্ত্রণায় ছিলাম, সে কথা কাউকে বোঝাতে পারব না।’ ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ছাত্র রেদোয়ান আহমেদের বাবা অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদও ছেলের জামিন হওয়ায় আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘ছেলের জামিন হওয়ায় খুব ভালো লাগছে। আমার বাবা এবার আমাদের সঙ্গেই কুরবানির গুরু কিনতে যেতে পারবে।’ তার মতো অন্য বাবারা বলেন, এবার আমাদের সন্তানরা মুক্তি পেল। আটক অন্যদেরও যেন খুব দ্রুত মুক্তি দেওয়া হয় সে জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানান তারা।##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন