শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বিপন্ন কর্ণফুলী-হালদা

গিলছে হাজারেরও বেশি অবৈধ স্থাপনা পরিণত হচ্ছে আরেক বুড়িগঙ্গায়

শফিউল আলম : | প্রকাশের সময় : ২১ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০২ এএম

কর্ণফুলী এবং হালদা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক নদী। প্রধান সমুদ্র বন্দরের ধারক ও প্রাণপ্রবাহ পাহাড়ি খর স্রোতা কর্ণফুলী। আর এশিয়ায় মিঠাপানির বড় জাতের মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা। কিন্তু অব্যাহত দখল, ভরাট ও দূষণের কারণে বিপন্ন হয়ে উঠেছে কর্ণফুলী ও হালদা। উভয় নদীকে গিলছে এক হাজারেরও বেশি বাড়িঘর, দোকানপাট, কারখানা, ঘাটসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ স্থাপনা। মারাত্মক দূষণে ক্রমাগত বিষিয়ে পরিণত হচ্ছে নদীটি আরেক বুড়িগঙ্গায়।
নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সম্প্রতি নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান কর্ণফুলী ও হালদার মোহনায় বিভিন্ন এলাকা পর্যবেক্ষণকালে দূষণ-ভরাট-দখলে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ইতোপূর্বে কর্ণফুলী সুরক্ষায় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়ার জন্য উচ্চ আদালত নির্দেশনাও প্রদান করেন। অথচ এখনো উভয় নদী বাঁচাতে সরকারের তরফ থেকে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, কর্ণফুলী ও হালদা নদীর মোহনার বিস্তীর্ণ অংশে নতুন জেগে ওঠা চরের জমিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে এক থেকে দেড় হাজার বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। অনেকগুলো গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব এলাকার ভেতরে (পোর্ট লিমিট) এবং বন্দর নেভিগেশন চ্যানেল ঘেঁষে। জেলা প্রশাসনও বলছে এসব স্থাপনা অবৈধ।
স্থানীয় লোকজন জানান, বসতঘর দোকান-পাটসহ বেশিরভাগ টিনের তৈরি ও আধাপাকা অবৈধ স্থাপনা রাতারাতি নির্মিত হয়। তথাকথিত সংগঠন-সমিতির নামে প্রভাবশালী একটি চক্রের বেদখলে রয়েছে। ওরাই ভাড়া তুলছে। পকেট ভরছে। গতবছর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কর্তৃক কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবৈধ স্থাপনাসমূহ চিহ্নিত ও তালিকা তৈরি করা হয়। সেখানে বেদখল হয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ ১৫৬ একরেরও বেশি। যার বেশিরভাগই নতুন পলিমাটির ভূমি। উচ্ছেদ অভিযান অনেক আগেই শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা দৃশ্যমান হয়নি এখনো। প্রশাসনের সূত্র জানায়, কর্ণফুলী সুরক্ষায় অভিযান পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট হাতে পাওয়া গেলেই উচ্ছেদ কার্যক্রম শিগগিরই শুরু হবে।
কর্ণফুলী ও হালদা নদী বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া জানান, কর্ণফুলী ও হালদা নদীর সাথে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ জড়িত। প্রকৃতির অপার দান কর্ণফুলী ও হালদা। বাংলাদেশের অন্য যে কোনো নদ-নদীর চেয়ে কর্ণফুলী ও হালদার স্বতন্ত্র বেশকিছু ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, অবস্থান এবং জীববৈচিত্র্য রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে এ দুটি নদীর অবদান অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন, উভয় নদীকে সুরক্ষায় আমাদের সমন্বিতভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এরজন্য সব ধরনের অবৈধ দখল, ভরাট ও দূষণ বন্ধ করা এবং উভয় নদীর তীররেখা চিহ্নিত করা ও বাঁধানো প্রয়োজন। জাতীয় অর্থনীতির হৃদপিন্ড চট্টগ্রাম বন্দর। বন্দর ও চট্টগ্রামবাসীর প্রাণ হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। কর্ণফুলী বাঁচলে বন্দর বাঁচবে। আর রুই কাতলা মৃগেল মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা মাছের ভান্ডার। একে রক্ষা করতে হবে।
বিশেষজ্ঞ সূত্রে জানা গেছে, এক-দেড় হাজারেরও বেশি অবৈধ স্থাপনা ছাড়াও নদীর তীরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা কল-কারখানা, ট্যানারী, পেপার মিলস, গার্মেন্টস কারখানাসহ বিভিন্ন উৎস থেকে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে কর্ণফুলী ও হালদা নদী। দেশি-বিদেশি জাহাজ, কোস্টার, নৌযান, ট্রলারের বিষাক্ত বর্জ্য, পোড়া তেল ও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে নদী দুটি। এতে করে মৎস্য সম্পদ বিরান হয়ে যাচ্ছে। কর্ণফুলী নদীতে চিংড়িসহ দু’শ প্রজাতির সুস্বাদু মাছ অতীতে পাওয়া যেতো। ইদানীং অন্তত ৫০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা বিলুপ্তির পথে। মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে।
ক্রমাগতই বিষিয়ে উঠেছে দুটি নদীর পানি। নদীর পানির স্বাভাবিক রঙ, স্বাদ নেই। ৬০ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত চট্টগ্রাম মহানগরীর বিশাল অংশের বর্জ্য গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলীতে। চট্টগ্রাম শহরতলী, হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ি উপজেলার কারখানাগুলো ও হরেক উৎস থেকে বিষাক্ত বর্জ্য-আবর্জনা, জমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার কীটনাশক দ্রব্যাদি হালদা নদীকে বিষিয়ে তুলেছে। যার পরিণতিতে সম্প্রতি হালদায় রুই কাতলাসহ মা-মাছ মারা যায় ব্যাপকহারে।
কর্ণফুলী নদীর মোহনা বেদখলের সাথেই নদীর বুক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নাব্য ও গতিপথ রক্ষায় নদীশাসন, নিয়মিত ড্রেজিং ও দুষণরোধ জরুরি। তবে এ বিষয়টি দীর্ঘদিন উপেক্ষিত। জমির দাম বাড়ার সাথে সাথে চলছে ভরাট ও বেদখলের প্রতিযোগিতা। চওড়ায় ও গভীরতায় ছোট হয়ে আসছে উভয় নদী। পানির প্রবাহ ও ধারণক্ষমতা হারিয়ে বর্ষায় ডুবছে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, আগ্রাবাদসহ ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পাঞ্চল। এককালে বন্দরের কর্মব্যস্ত ওমর আলী ঘাট, অভয়মিত্র ঘাট, মনোহরখালী মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও এর আশপাশের এলাকায় চর জেগে নদী ভরাট ও মরা বন্দরে রূপ নিয়েছে। কর্ণফুলী সেতু থেকে সদরঘাট লাইটারেজ জেটি পর্যন্ত আশঙ্কাজনক হারে ভরাট হয়ে নদীর গভীরতা কমেছে। বন্দরের ১নম্বর জেটি অতিক্রম করে গেছে পলিবালির আস্তর। সঙ্কটের মুখে পড়েছে নাব্যতা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন