রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগের ভয় এখন আতংকে রূপ নিয়েছে। প্রায় প্রতি বছরই জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়। এর আগে পরেও হয়; তবে তুলনায় কম। এবার গত বছরের চেয়ে প্রকোপ বেশি। খবরে প্রকাশ, গতকালের পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ৩৭জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ভর্তি হয়েছে। গত মাসে গড়ে প্রতিদিন ভর্তি হয়েছে ৪৪ জন। সরকারি হিসাবে, জানুয়ারি থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ২৬৩২ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ১০ জন : আগস্টে তিন জন, জুলাইয়ে চার জন এবং জুনে তিন জন। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে ১৩২ জন। আইইডিসিআর’র পরিচালক জানিয়েছেন, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এবার বেশী, যা উদ্বেগজনক। জুলাই-আগস্টে প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্ষা মওসুমে ডেঙ্গু রোগের ব্যাপক বিস্তারের কারণ হলো, এ সময় বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে। আবদ্ধ এসব পানিতেই মশার প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি ঘটে। এডিস নামের এক শ্রেণীর মশা ডেঙ্গুর জীবাণু বহণ ও বিস্তার ঘটায়। তবে পুরুষ মশা নয়, স্ত্রী মশাই জীবণু বহণ ও বিস্তারের জন্য দায়ী। এই মশা স্বচ্ছ পানিতে ডিম পেড়েও বংশবিস্তার ঘটাতে পারে। সাধারণত কয়েকদিন পর পর বৃষ্টি হলে এডিস মশার প্রজননে সুবিধা হয়। এবার কয়েকদিন পর পর বা মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে বৃষ্টি হওয়ায় এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির এটাই কারণ। জ্বর ও সেই সঙ্গে গা-গতরে ব্যাথা ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান লক্ষণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, চার-পাঁচ দিন একনাগাড়ে জ্বর ও গা-গতরে ব্যথা থাকলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ। শুরুতেই চিকিৎসা নেয়া হলে শংকার কোনো কারণ নেই। ভালো না হওয়া পর্যন্ত রোগীকে সর্তক থাকতে হবে। বিশ্রামে থাকতে হবে এবং প্রচুর পানি, শরবত ও তরল খাবার খেতে হবে। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসা নিতে অবহেলা বা বিলম্ব ঘটলে রোগীর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের আশংকা থাকে, যা আরো বিলম্বে জীবন সংশয়ের কারণ হতে পারে।
প্রায় সব রোগের ক্ষেত্রেই বলা হয়, চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থাই শ্রেয়। ডেঙ্গুরোগের ক্ষেত্রেও একথা সমান প্রযোজ্য। বিশেষ শ্রেণীর মশাই যেহেতু এ রোগের কারণ সুতরাং সেই মশা নির্মূল বা তার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করলেই রোগের আশংকা থেকে মুক্ত থাকা বা রেহাই পাওয়া সম্ভব। ভাঙ্গা-চোরা রাস্তার খাদ, খোলা নদর্মা, ডাবের পরিত্যাক্ত খোলা, ভাঙ্গা পাত্র, ফুলের টব ইত্যাদিতে জমে থাকা পানি এডিস মশার ডিম পাড়ার ও বংশবিস্তারের নিরাপদ স্থান হিসাবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব স্থানে যাতে পানি জমে থাকতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যেতে পারে। এজন্য প্রয়োজন সচেতনতা ও নজরদারি। রাজধানীতে সর্বত্রই ময়লা-আর্বজনা দিনের পর দিন জমে থাকতে দেখা যায়। এসব স্থান মশার প্রজনন স্থল হিসাবে গণ্য। তাছাড়া লেক, খাল, পুকুর, জলাশয়গুলোও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয়। এসব জায়গাতেও প্রতিনিয়ত বিভিন্ন শ্রেণীর মশার জন্ম ও বংশবিস্তার হচ্ছে। নগরকে সব দিক দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের। দেখা যায়, এক্ষেত্রে তারা দায়সারা গোছের কাজ করে থাকে। মশা নিধনে দুই সিটি করপোরেশনের কর্মসূচী আছে, বাজেটও আছে। অথচ প্রতিবছরই অভিযোগ ওঠে, ওই কার্যক্রম ঠিকমত চালানো হয়না। ফগার মেশিন দিয়ে মাঝে-মধ্যে মশা তাড়ানোর মহড়া ছাড়া তেমন কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। ফেলে দেয়া ময়লা-আবর্জনা দ্রুত সরিয়ে নেয়া কিংবা আবদ্ধ পানির আঁধারগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার ক্ষেত্রেও রয়েছে নিদরুণ অবহেলা ও উপেক্ষা। নগরজীবনে ডেঙ্গু বড় রকমের আতংক হয়ে দেখা দিলেও দুই সিটি করপোরেশনের তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে এখনো দেখা যায়নি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সে কাজেও কোনো তৎপরতা লক্ষ্যণীয় নয়।
এ ব্যাপারে দুই সিটি করপোরেশনের যেমন এগিয়ে আসা দরকার, তেমনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও দায়িত্ব এড়িয়ে নিরব থাকতে পারেনা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও দুই সিটি করপোরেশনের ডেঙ্গু প্রতিরোধে এখনই একটি সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিৎ বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। পরিস্থিতির যেভাবে দ্রুত অবনতি ঘটছে তাতে এ কার্যক্রম অত্যন্ত জরুরি। যেহেতু নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি এক্ষেত্রে অধিকতর সুফল দিতে পারে সেহেতু এই কাজটিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। ওয়ার্ড কমিশনারদের একাজে বিশেষভাবে নিয়োজিত করতে হবে। নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের নগর পরিচ্ছন্ন করারও উদ্যোগ নিতে হবে। নগরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা সম্ভব হলে অনেক ক্ষেত্রেই ঝুঁকি কমবে। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ভূমিকা রাখতে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থী সমাজও। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে কিশোর শিক্ষার্থীরা যে ভূমিকা রেখেছে তা সর্ব মহলেই প্রশংসিত হয়েছে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তাদের শিক্ষার্থীরা ছুটির দিনে বা অবসরে নগর নির্মল ও পরিচ্ছন্ন করার কাজে রাখতে পারে অনেক বড় ভূমিকা। সব কিছু সরকার, সিটি করপোরেশন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ করবে, আমাদের কিছুই করণীয় নেই, এমন মনোভাব মোটেই ভালো নয়। নাগরিকদেরও নিজেদের সুবিধা ও কল্যাণে যতটা সম্ভব কাজ করতে হবে, ভূমিকা রাখতে হবে। বলা বাহুল্য, কর্তৃপক্ষীয় উদ্যোগের সঙ্গে নাগরিক উদ্যোগ সংযুক্ত হলে আমাদের জীবন-যাপন অনেক বেশী নিরাপদ, মসৃণ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়ে উঠতে পারে ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন