বহুল আলোচিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প থেকে ভারত যে সরে আসেনি তার প্রমাণ পাওয়া গেছে সে দেশের পানিসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতীর বক্তব্যে। এই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের ঘোর আপত্তি ও বিরোধিতা রয়েছে। খোদ ভারতেও বিশেষজ্ঞরা এবং পরিবেশবাদীরা এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সোচ্চার। বিশ্বের কোথাও আন্তঃনদী সংযোগ সুফল বয়ে আনে নি। এতে নদীর প্রাকৃতিক চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য বিপন্ন হয়েছে, মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে এবং পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। অথচ ভারত এই অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞদের মতামত অগ্রাহ্য করে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে জেদ ধরে আছে। মাঝখানে এই প্রকল্প ও তার বাস্তবায়ন নিয়ে কথাবার্তা কিছুটা কম শোনা গেলেও বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর তা আবার আলোচনায় ফিরে এসেছে। ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়, প্রকল্পটি যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা হবে। এরপর উদ্যোগ-প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যায়। গত বুধবার দিল্লীতে ইন্ডিয়া ওয়াটার ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উমা ভারতী সাফ বলে দিয়েছেন, প্রকল্পের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে ভারত। আরও বলেছেন, ‘নদী সংযোগ নিয়ে ভাবা ছাড়া আমাদের কোনো গতি নেই।’ বিরোধিতাকারীদের কথা খেয়াল রেখে তিনি বলেছেন, ‘তবে যেসব নদীতে পানি উদ্বৃত্ত এবং যেখানে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের কারণে প্রবাহ বেশী সেগুলোকেই শুধু নতুন নদীর সঙ্গে যুক্ত করা হবে। নিশ্চিত থাকুন, এটা করা হবে মানুষ বা পরিবেশের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেটা মাথায় রেখেই।’ উমা ভারতী এও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, এ ব্যাপারে ভারত ইসরাইলের দেখানো পথ অনুসরণ করবে। প্রকল্প নিয়ে ভারত ইসরাইলের স্মরণাপন্ন হবে, এমনটাও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
উমা ভারতীর বক্তব্যে আরো জানা গেছে, ভারতের প্রথম টার্গেট হলো মানস-সংকোশসহ গোটা ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা। আগে থেকেই ভারত বলে আসছে, এই অঞ্চলে উদ্বৃত্ত পানি রয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পানির ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশে উভয় মওসুমে সবচেয়ে বেশী পানি আসে ব্রহ্মপুত্র থেকে। ওয়াকিবহাল মহলের স্মরণ থাকার কথা, গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যখন আলোচনা হয় তখন ভারতের তরফে বলা হয়েছিল, গঙ্গার পানি সংকট আসলে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় সংকট। এ সংকটের সমাধান হতে পারে যদি পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করা যায়। তখন ভারত এই মর্মে প্রস্তাব দিয়েছিল যে, ব্রহ্মপুত্রের পানি যদি লিংক ক্যানেলের মাধ্যমে গঙ্গায় টেনে আনা যায় তাহলে গঙ্গার প্রবাহ সংকট আর থাকবে না। উভয় দেশই পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় পানি পাবে। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। বাংলাদেশ পাল্টা প্রস্তাব দিয়েছিল নেপালে রিজার্ভার নির্মাণ করে এটা মওসুমের পানি ধরে রেখে শুকনো মওসুমে তা গঙ্গায় ছেড়ে দিয়ে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করার। বাংলাদেশ এও বলেছিল, এতে পানির প্রবাহ সংকটই দূর হবে না, পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তিন দেশ তাদের বিদ্যুৎ চাহিদাও অনেকাংশে মেটাতে পারবে। বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনে নেপালকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবও দিয়েছিল। ভারত বাংলাদেশের দু’টি প্রস্তাবের একটিও মানে নি। নেপালে রিজার্ভার নির্মাণ করে পানি সংরক্ষণ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তাব সব দিক দিয়ে যৌক্তিক ও বাস্তবোচিত হলেও এবং নেপাল এ প্রস্তাবে রাজি থাকলেও ভারত প্রস্তাবটি গ্রহণ করেনি । না করার মূল কারণ যে বাংলাদেশকে পানিবঞ্চিত বা পানি সংকটে রাখা তা তখন যেমন তেমনি এখনো বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের প্রথম টার্গেট থেকে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, এটা ভারতের প্রথম টার্গেট নয়, প্রধান টার্গেটও বটে।
বাংলাদেশ শুরু থেকেই ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে। এই নদী সংযোগ প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি সরিয়ে নেয়া। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা সম্পূর্ণ একমত। প্রকল্পের রূপরেখা খতিয়ে দেখলেও সেটা বুঝা যায়। যখন আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় মানস-সংকোশসহ ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পানি সরিয়ে নেয়ার মতলব জানা যাচ্ছে তখনই অন্য এক খবরে জানা গেছে, সারদা নদীর পানি লিংক ক্যানেলের মাধ্যমে সবরমতী নদীতে নিয়ে যাওয়ার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সারদা নদী গঙ্গার পানির অন্যতম উৎস। ওদিকে এমন খবরও আছে, টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের কাজও ভারত চালিয়ে যাচ্ছে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, এভাবে ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও বরাকের পানি সরিয়ে নেয়া হলে বাংলাদেশের পানির অভাবে শুকিয়ে মরতে হবে। ইতোমধ্যে অধিকাংশ নদী মরে গেছে বা মরণদশায় ধুঁকছে। এসব নদীর আর কোনো চিহ্ন থাকবে না। তখন মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কোনো শেষ থাকবে না। এ ব্যাপারে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি বা খেয়াল আছে, বাস্তবতা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। সরকার ব্যস্ত আছে ‘ভারত ভোষণে’ এবং ভারত যা চায় তা দিয়ে দেয়ার প্রতিযোগিতায়। দেশ ও দেশের মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত পানি সমস্যার সমাধানে কোনো উদ্যোগ-পদক্ষেপ নেই। পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের কোনো গরজ নেই। আমরা আশা করবো, ভারত পানি নিয়ে কি করছে, কোথায় কি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, সরকার তার খোঁজ-খবর নেবে এবং এ বিষয়ে জনগণকে অবগত করবে। একই সঙ্গে ভারতের ‘পানি রাজনীতি’ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ও যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন