শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ভয়াবহ নদীভাঙন

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০১ এএম | আপডেট : ১২:১৫ এএম, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ এবং গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীর উজানে চীন, ভারত থেকে ভাটিতে বাংলাদেশের দিকে প্রবল বেগে নামছে ঢলের পানি। অন্যতম প্রধান অববাহিকা ব্রহ্মপুত্রের উজানে চীন-ভারত হয়েছে মারাত্মক বন্যা কবলিত।
এক মাসেরও বেশিদিন যাবত এমনকি গত শ্রাবণেও দেশের অভ্যন্তরে বৃষ্টিপাত তেমন নেই। এর ফলে বাংলাদেশে আপাতত বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবে উজানের ঢল-বানের পানি তীব্র গতিতে নামছে দেশের নদ-নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে। অব্যাহত ঢলের তোড়ে দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে ভাটিতে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত অনেক স্থানে ভয়াবহ নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। দিনে দিনে বিস্তৃত হচ্ছে ভাঙন। গতকালও (বৃহস্পতিবার) বিভিন্ন স্থানে নদ-নদীর তীব্র ভাঙনে নদীপাড়ের অগণিত মানুষ হয়ে পড়েছে দিশেহারা। প্রাচীন মসজিদ, মাদরাসা, হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর থেকে শুরু করে ফসলি জমি একের পর এক বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদ-নদীর করাল ঘূর্ণিস্রোতে। অনেক জায়গায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধেও ভয়াবহ ধস, ভাঙন ও ফাটল দেখা দিয়েছে। ক্রমবর্ধমান ভাঙনের মুখোমুখি রয়েছে অনেক এলাকা।
স্থানীয় বাসিন্দারা বাপ-দাদার বসতঘর ছেড়ে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। হন্যে হয়ে ছুটছে মানুষ ভাঙনের এলাকাগুলো ছেড়ে নিরাপদ স্থানে একটু মাথাগোঁজার আশ্রয়ের সন্ধানে। পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের নিত্যদিনের দুর্ভোগ সীমাহীন। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, উত্তর জনপদের তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী পাড়ের কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনির হাট, গাইবান্ধা থেকে শুরু করে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, আরিচা, টাঙ্গাইল এবং পদ্মায় রাজবাড়ী গোয়ালন্দ, ভাগ্যকুল, মাওয়া, সুরেশ্বর মুন্সীগঞ্জসহ নদী পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা পর্যন্ত ভয়াবহ ভাঙনে গ্রাস করছে গ্রাম-জনপদ। প্রতিদিন সকালেই এসব নদ-নদী পাড়ের মানচিত্র যাচ্ছে পাল্টে। অথচ নদ-নদীর ভাঙন রোধে আগাম কোনো ধরনের প্রস্ততি বিশেষ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোর উপযুক্ত সংস্কারের মাধ্যমে টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি সময়মতো। শুধুই জোড়াতালি মেরামত দিয়ে দায় সারানোর চেষ্টা করা হয়েছে। নদী ভাঙন রোধে কংক্রিটের বøক ফেলা হয়েছে অপরিকল্পিত ও বিক্ষিপ্তভাবে। তাতে কারচুপি ও শুভঙ্করের ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় জনগণের মাঝেও। এ নিয়ে উপযুক্ত তদারকির অভাব রয়েছে। স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে বিরাজ করছে ক্ষোভ-অসন্তোষ।
এদিকে ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তিস্থল চীনের সাংপো, ভারতের অরুণাচলে সিয়াং নদী ও উজানে আসামের ব্রহ্মপুত্র নদের পানি অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে। ফলে চীন ও উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল ও আসাম রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভারতে সাতটি জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে।
এদিকে গতকাল সর্বশেষ বন্যা পূর্বাভাসে পাউবো জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। গতকাল দেশের ৯৪টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৫২টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি এবং ৩৬টিতে হ্রাস পায়। ৫টি পয়েন্টে অপরিবর্তিত থাকে। গত বুধবার ৪৯ পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি এবং ৩৬টিতে হ্রাস পায়। পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র দশ দিনের সম্ভাব্য পূর্বাভাসে গত বুধবার) জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের পানির সমতল স্থিতাবস্থা থেকে বৃদ্ধি পেতে পারে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকার বাহাদুরাবাদ থেকে আরিচা স্টেশন পর্যন্ত পানির সমতল সতর্কসীমায় (বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটারের মধ্যে) পৌঁছাতে পারে।
পাউবো পূর্বাভাসে জানায়, অন্যদিকে গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদী অববাহিকায়ও পানির সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে। পদ্মা নদীর পানির সমতল গোয়ালন্দ স্টেশনে আগামী ৫ দিনের মধ্যে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটারের মধ্যে পৌঁছাতে পারে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানির সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে পূর্বাভাসে ঢাকার আশপাশের নদ-নদীগুলোর পানির সমতল বিপদসীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা নেই।
রাক্ষুসী প্রমত্তা উত্তাল পদ্মা যমুনা যেন কেড়ে নিয়েছে নদী পাড়ের মানুষ রাতের ঘুম। কখন নদী ভাঙে, কখন যে পাততাড়ী গোটাতে হয় এই চিন্তায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রিত মানুষের প্রতিনিয়ত বাড়ছে হৃদয় কম্পন। ইতোমধ্যে নব যৌবনা যমুনা-পদ্মার উত্তালে সিরাজগঞ্জ-কাজীপুর উপজেলা ভেঙে জামালপুরের সাথে মিলে গেছে আর চৌহালী উপজেলা মানচিত্র থেকে মুছে গিয়ে মিলেছে টাঙাইল জেলার সাথে। বিলীন হয়েছে কয়েক হাজার হেক্টর কৃষি জমি, রাস্তাঘাট, বাজার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ঐতিহাসিক মাদরাসা ও মসজিদ কমপ্লেক্স, কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, কেদারপুর ইউনিয়ন ভুমি অফিস, কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক, সরকারি বেসরকারী ব্যাংক ও বিমা অফিস, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ কয়েক হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গত বুধবার সকাল থেকে এ পর্যন্ত শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ২শ’ বছরের পুরনো মুলফৎগঞ্জ বাজারের দুটি মসজিদসহ প্রায় ২০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আশপাশের অর্ধশতাধিক কাঁচা পাকা বসতঘর পদ্মার গর্ভে চলে গেছে।
ভাঙনের মুখে শরীয়াতপুরের মূলফৎগঞ্জ বাজারের ৪তলা বিশিষ্ট দেওয়ান ক্লিনিক এÐ কম্পিউটারাইজড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, লাইফ কেয়ার হাসপাতাল এÐ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনসহ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। হুমকির মুখে রয়েছে ঐতিহাসিক মুলফৎগঞ্জ মাদরাসা কমপ্লেক্স ভবন, দুটি প্রাইমারী স্কুল ও ৫ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ পুরো মুলফৎগঞ্জ বাজার, সিরাজগঞ্জসহ চৌহালীর এনায়েতপুরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ, সদরের বঙবন্ধু যমুনা সেতুর পশ্চিম পাড়ের গাইড বাঁধ, পূর্ব পাড়ের টাঙাইল অংশের বাঁধ, রাজবাড়ী গোয়ালন্দের শহর রক্ষা বাঁধ, প্রস্তাবিত সেনানিবাস, ফেরীঘাট, কয়েক হাজার বসতবাড়ী, কৃষিজমি মাদরাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। আমাদের শরীয়তপুরে জেলা সংবাদদাতা মো: হাবিবুর রহমান হাবীব, সিরাজগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা সৈয়দ শামীম শিরাজী, গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) উপজেলা সংবাদদাতা মো: নজরুল ইসলাপম খানে পাঠানো তথ্যে এমন করুন চিত্র ফুটে ওঠে।
জানা গেছে, ভাঙনে নিঃস্ব মানুষগুলো খোলা আকাশের নীচে নানাবিধ ঝড়-ঝাপটা সহ্য করে মানবেতর জীবন যাপন করছে। রাক্ষসী করাল গ্রাস পদ্মা-যমুনা করেছে তাদের রিক্ত, নিঃস্ব, সর্বশান্ত। অনেক এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা বন্ধ রয়েছে। তারপরেও এই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ আশ্রিত মানুষ প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রামে যুদ্ধ করে চলেছে। তাদের দুঃখের সীমা নেই।নেই কোন সমাধান। সমস্যা যে তিমিরে ছিলো সেই তিমিরে রয়ে গেছে। সরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও ভাঙন রক্ষায় তা অপ্রতুল। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ না হলে ভবিষ্যতে অনেক নতুন এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হবার আশঙ্কা করেন বিশেষজ্ঞরা।
শরীয়তপুর থেকে মো: হাবিবুর রহমান হাবীব জানান, শরীয়তপুরের নড়িয়া গত বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে এ পর্যন্ত ২শ’ বছরের পুরনো একটি সমৃদ্ধশালী বাজারের দুটি মসজিদ সহ প্রায় ২০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আশপাশের অর্ধশতাধিক কাচা পাকা বসতঘর পদ্মার গর্ভে চলে গেছে। ভাঙনের মুখে মূলফৎগঞ্জ বাজারের ৪তলা বিশিষ্ট দেওয়ান ক্লিনিক এÐ কম্পিউটারাইজড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, লাইফ কেয়ার হাসপাতাল এÐ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনসহ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। হুমকির মুখে রয়েছে ঐতিহাসিক মুলফৎগঞ্জ মাদ্রাসা কমপ্লেক্স ভবন, দুটি প্রাইমারী স্কুল ও ৫ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ পুরো মুলফৎগঞ্জ বাজার।
এছাড়া হুমকির মুখে রয়েছে নড়িয়া উপজেলা শহর, নড়িয়া পৌরবাজার, পৌর ভবন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়, নড়িয়া সরকারী খাদ্য গুদাম, নড়িয়া সরকারী কলেজ, নড়িয়া বিএল উচ্চ বিদ্যালয়, নড়িয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সহ অসংখ্য সরকারী-বেসরকারী অফিস, ব্যাংক-বীমা অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পুরনো ঐতিহ্যবাহী সহ¯্রাধিক স্থাপনা।
গত ২১ আগস্ট মুলফৎগঞ্জ বাজার সংলগ্ন গাজী কালুর মেহমানখানা নামে ৫তলা বিশিষ্ট প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বিলাসবহুল একটি বাড়ি, খান বাড়ি জামে মসজিদ ও দিলু খার দ্বিতল পাকা বাড়ি একসাথে পদ্মার গর্ভে চলে যায়। ভাঙনের মুখে হজরত খাজা মইনুদ্দিন গাজী কালু মঞ্জিল নামে চারতলা বিশিষ্ট আরেকটি বিলাসবহুল বাড়ি ভেঙে গুরুত্বপূর্ণ মালামাল সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ওইদিন থেকে এ পর্যন্ত নড়িয়া-মুলফৎগঞ্জ সড়কের কয়েকটি পয়েন্টে প্রায় ৩শ মিটার এলাকা পদ্মায় বিলিন হয়ে নড়িয়া-মুলফগঞ্জ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সাধুর বাজার, কেদারপুর, বাঁশতলা, চরজুজিরা, সেহেরআলী মাদবর কান্দি বিলিন হয়ে গেছে কিছুদিন আগে।
এর আগে গত ৭ আগস্ট দুপুরে হঠাৎ করে মুলফৎগঞ্জ বাজার সংলগ্ন লঞ্চঘাটের বিস্তৃর্ণ এলাকা ধসে গিয়ে ৩০ জন লোক পদ্মায় তলিয়ে যায়। এদের মধ্যে নিখোঁজ হয় ৯ জন। নিখোঁজের ৭ দিন পর চাঁদপুর সীমান্ত এলাকা থেকে ২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা গেলেও বাকিদের এখনও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ভাঙন আতঙ্কে দিশেহারা পদ্মা পাড়ের মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন। তিন সহ¯্রাধিক মানুষ তাদের সাঁজানো ঘরবাড়ি ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন। খোলা আকাশের নিচে অনাহারে অর্ধাহারে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তারা। ভাঙন কবলিতদের আহাজারীতে ভারি হচ্ছে পদ্মার পাড়। পদ্মার আগ্রাসী রূপ দেখতে প্রতিদিন ভির করছে হাজারো মানুষ। ভাঙন রোধে দ্রæত ব্যবস্থা নিতে দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
এদিকে পদ্মার ভাঙন থেকে নড়িয়া উপজেলা শহরকে বাঁচাতে গত ১১ জুলাই থেকে ভাঙন এলাকায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড। শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, এ পর্যন্ত লক্ষাধিক ব্যাগ নদীতে ফেলা হয়েছে। কিন্তু তীব্র ¯্রােতের কারণে কিছুতেই ভাঙন রোধ করা যাচ্ছে না।
সিরাজগঞ্জ থেকে সৈয়দ শামীম শিরাজী জানান, বৃহত্তর সিরাজগঞ্জ-পাবনার উত্তরের বেড়াকোলা থেকে রংপুরের কাউনিয়া পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রিত প্রায় ৫০ হাজার পরিবার ভাঙন আতংকে ভুগছে। রাক্ষুসী প্রমত্তা উত্তাল যমুনা যেন তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। ইতোমধ্যে নদী ভাঙনে সিরাজগঞ্জ-কাজীপুর উপজেলা ভেঙে জামালপুরের সাথে মিলে গেছে আর চৌহালী উপজেলা মানচিত্র থেকে মুছে গিয়ে মিলেছে টাঙাইল জেলার সাথে। সিরাজগঞ্জসহ চৌহালীর এনায়েতপুরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ এখন হুমকির মুখে। সদরের বঙবন্ধু যমুনা সেতুর পশ্চিম পাড়ের গাইড বাঁধের অবস্থা একই। পূর্ব পাড়ের টাঙাইল অংশেও ভাঙনে বাঁধ।
সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে কাওয়াকোলা ইউনিয়নের বয়বৃদ্ধ রমজান আলী জানান, বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলাখানা ঘাট থেকে শহরের দুরত্ব ছিল প্রায় ৮/১০ মাইল। সিরাজগঞ্জের হেলিপড, খেলারমাঠ সবই যমুনা গ্রাস করছে এখনও করছে। ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে এই কাওয়াকোলা ইউনিয়ন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বলেও তিনি জানান।
সিরাজগঞ্জ নলকা ব্রিজ এলাকার আমজাদ আলী জানায়, এই নলকা সেতুর পশ্চিম দিকের উভয় পাশ থেকে পাহাড় পরিমাণ বালু উত্তোলন করার কারণে সেতুটি ডেবে যায়। মহসড়কে যানজট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বালু মহল জব্দ করা হয়। ভারী যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞাজারীসহ জরিমানা করা হয়। অথচ বর্তমানে সেই নলকা সেতুর উভয় দিকে ৫/৬ টি ড্রেজার বসিয়ে নির্বিঘেœ বালু উত্তোলন করছে বালু দস্যুরা। অথচ প্রশাসন নীরব ভূমিকায় অবতীর্ণ। আবার বিপদ সংকেত বেজে উঠলে সক্রিয় হবেন তাড়া ।এসব কাজে আবার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে। এরকম নাটকিয় খেলা চলবে আর কতদিন।
স¤প্রতি চরপেঁচাকোলা গ্রামবাসী ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হুড়াসাগর ও যমুনা নদীর মোহনায় সমবেত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন। তারা নদী ভাঙন এবং অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধের দাবি জানান। তারা বলেন, নদীর উত্তর পাড়ের পায়না গ্রামের সরকার দলের কিছু কিছু নেতার নেতৃত্বে প্রতিদিন গভীর রাত থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ৫০-৬০টি দেশি ড্রেজার ও ভলগেটের সাহায্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছে।
চরপেঁচাকোলা গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি আলহাজ মাওলানা আ. সোবহান জানান, গত ১৫ বছরে ভাঙনে যমুনা নদী প্রায় ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে সরে এসেছে। এতে অনেক গ্রাম, মসজিদ, হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাজার হাজার একর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রায় ২৫ হাজার পরিবার সহায় সম্বল হারিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে।
আশরাফ আলী আরো বলেন, নির্বাচন এলে চেয়ারম্যান ও মেম্বর পদপ্রার্থীরা ভোটের জন্য কাকুতি-মিনতি করেন। সকল সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। কিন্তু ভোটের পর তাদের দেখা পাওয়া যায় না। বাঁধবাসীদের সমস্যার কোনো সমাধান হয় না। বেড়া পাউবোর উপ-সহকারী প্রকৌশলী ভাঙনরোধ প্রকল্পের সাইড ইঞ্জিনিয়র মো. ওসমান গনি জানান, চরপেঁচাকোলায় ভাঙনরোধে এ পর্যন্ত প্রায় ৯ হাজার বালু ভর্তি জিও ব্যাগ নদীতে ডাম্পিং করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর বরাদ্দ চেয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া গেলে আবার ভাঙন রোধ কাজ শুরু করা হবে।
গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, পদ্মায় পানি বৃদ্ধি ও ভাঙণ তীব্রতায় রাজবাড়ীর শহর রক্ষা বেড়ী বাঁধ, গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ও দৌলতদিয়া ইউপি, কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়নের আওতাধীন এলাকা হুমকির মুখে পড়েছে। এতে নদীতীরবর্তি এলাকার ২০ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ ভাঙণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। মঙ্গলবার বিকালে রাজবাড়ী শহরের উপকণ্ঠে গোদার বাজার এলাকায় শহর রক্ষা বেড়ীবাঁধের ৬০মিটার অংশের বøক পদ্মা গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পদ্মাতীরবর্তি রাজবাড়ীর একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র এলাকাও ভাঙতে শুরু করেছে। এ নিয়ে গত ১১দিনে নদীগর্ভে বিলীন হলো শহর রক্ষা বাঁধের ১১০মিটার অংশ। এতে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে নদীতীরবর্তী এলাকাবাসী ও হুমকীর মধ্যে রয়েছে বহু স্থাপনা। বুধবার বিকালে গোদার বাজার এলাকায় বিনোদন কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, নদী ভাঙনের তীব্রতা। এভাবে ভাঙতে থাকলে ২/৩ দিনের মাঝেই বিলীন হয়ে যাবে নদীতীরবর্তী এ বিনোদন কেন্দ্রটি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রকাশ কৃষ্ণ সরকার জানান, গত মঙ্গলবার নদী ভাঙনের তীব্রতা ছিল ভয়াবহ। বøক দেয়া নির্মিত অংশের প্রায় ৬০ মিটার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। অতি দ্রæত কাজ করা হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন