শীত ও গ্রীষ্মে নদীগুলোর নাব্যতা সংকট এবং সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানির সংকট ছিল আলোচ্য বিষয়। এখন বর্ষা শুরু হতে না হতেই শুকনো নদীবক্ষে উজানের ঢলে নেমে আসা পানির প্রাবল্য দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ বর্ষার প্রচ- তোড়ে বিধ্বংসী হয়ে উঠেছে মেঘনা, যমুনা, তিস্তা। এসব নদীপাড়ের জনপদগুলোতে ভাঙনের কবলে পড়ে প্রতিদিন শত শত পরিবার ঘরবাড়ি, ভিটেমাটি হারাচ্ছে। গতকাল প্রকাশিত বগুড়া থেকে পাঠানো ইনকিলাব প্রতিনিধির রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, যমুনা নদীতে গত কয়েক দিনের ভাঙনে শুধুমাত্র বগুড়ার সারিয়াকান্দিতেই শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়েছে। এ সময় উঠতি ফসলসহ শত শত একর কৃষিজমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদীভাঙনে ঘরবাড়ি, স্কুল, মসজিদ-মাদরাসা, রাস্তা, ব্রীজসহ অসংখ্য পাকা ও কাঁচা অবকাঠামো নদীতে বিলীন হয়ে শত শত কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। শুষ্ক মওসুমে নদী শুকিয়ে ধূ-ধূ-বালুচর এবং শীর্ণ নালায় পরিণত হওয়া, অতঃপর বর্ষা শুরু হতে না হতেই নদীভাঙনের এই বিধ্বংসী চিত্র আমাদের দেশে এখন সাংবাৎসরিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উজানে ভারতের বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহারের কারণে নদীর স্বাভাবিক স্রোতধারা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় নদীতে পলিজমে পানিধারণ ক্ষমতা কমে গেছে, বর্ষায় উজানের ছেড়ে দেয়া পানি ভাটিতে ভরাট হয়েপড়া নদীধারণ করতে পারে না। এ কারণে নদী প্রবল ভাঙন ও বন্যার সৃষ্টি করে।
পঞ্জিকার হিসাবে আষাঢ়ের প্রথমার্ধ এখনো পার হয়নি। গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, এরই মধ্যে তিস্তার বন্যায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। মাত্র কিছুদিন আগেও তিস্তাপাড়ের লাখ লাখ কৃষক পানির জন্য হাহাকার করেছে। এখন তাদের ফসলিজমিসহ ঘরবাড়ি পানির তোড়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে অথবা উজানের ঢলে তলিয়ে গিয়ে তারা পানিবন্দি হয়ে পড়ছে। সীমান্তের ওপার থেকে ধেয়ে আসা ঢল এবং দু’দিনের ভারী বর্ষণে তিস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে দিয়ে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নদী। ধারণ ক্ষমতা উপচানো পানি তিস্তা, ধরলা, বুড়ি তিস্তা, সতি ও সানিয়াজান নদীর অববাহিকায় অপ্রত্যাশিত প্লাবন সৃষ্টি করেছে। তিস্তা ব্যারাজের সব গেট খুলে দিয়েও পানি প্রবাহের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা পানি উন্নয়ন বোর্ড। রংপুর, বগুড়া, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ, লালমনিরহাটসহ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তিস্তা, ধরলা ও তাদের শাখা নদীগুলোর এই আকস্মিক বন্যায় অন্তত ১০টি ইউনিয়নের হাজার হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়ে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকটে পড়েছে বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। গত বুধবার ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ২৫ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল তিস্তা। গতকালও নদীগুলোতে পানিবৃদ্ধি অব্যাহত ছিল এবং এ বৃদ্ধি আরো কয়েকদিন অব্যাহত থাকবে বলে জানা যায়।
পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, মেঘনা, ইছামতি, ধরলাসহ দেশের আভ্যন্তরীণ এবং সীমান্তবর্তী সব নদ-নদীই এখন ভাঙন কবলিত। প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, প্রতিবছর নদীভাঙনে লক্ষাধিক পরিবার গৃহহীন হয়। আর স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত লক্ষাধিক হেক্টর কৃষিজমি ও জনপদ নদীভাঙনে বিলীন হয়েছে। সীমান্ত নদীর ভাঙনে বিলীন হওয়া ৫০ হাজার একর জমি ভারতের দখলে চলে গেছে। অন্যদিকে প্রতিবছর ভাঙনের কবলে নিঃস্ব হয়ে পড়া পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের কোন উদ্যোগ না থাকায় এসব পরিবারের বেশীরভাগই অতি দরিদ্র ও উদ্বাস্তু শ্রেণীতে পরিণত হচ্ছে। এভাবেই নদীভাঙন দেশে গণদারিদ্র্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এমনিতেই বাংলাদেশ বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম। গত বুধবার জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তৃতায় পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন বলেছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে দেশের ১৯ জেলায় ৭০টি উপজেলার ৪ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত বা প্রত্যক্ষ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বৃহত্তর অর্থে জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ দায়ী না হলেও দেশের আভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের সরকার ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারবে না। নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ও নাব্যতা সুরক্ষায় সরকারের পদক্ষেপ খুবই অপ্রতুল। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রতিবছর নদীব্যবস্থাপনায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে জনগণের ট্যাক্সের শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। নদীভাঙন রোধ, বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের নামে যে সব অর্থ খরচ করা হয়, তার বেশীরভাগই তেমন কোন কাজে আসে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একশ্রেণীর কর্মকর্তা, প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের সমন্বয়ে তৈরী হওয়া সিন্ডিকেট সরকারী দলের এমপি-মন্ত্রীদের ছত্রছায়ায় বছরের পর বছর ধরে এসব অর্থ লোপাট করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা সারা বছর অনেকটা ঘুমিয়ে কাটালেও বর্ষা শুরুর প্রাক্কালে তড়িঘড়ি করে বেড়িবাঁধ মেরামত, নদীভাঙন রোধের মত প্রকল্পগুলোর কাজে তোড়জোড় শুরু করে। আকস্মিক বন্যা ও নদীভাঙনের প্রাবল্যে এসব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজও পানিতে তলিয়ে যায়। এভাবেই উন্নয়নের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাজেটের শত শত কোটি টাকা পানিতেই যায়। এ বিষয়ে অনেক লেখালেখি হয়। প্রভাবশালী মন্ত্রীদের ক্ষোভ ও অসন্তোষের কথাও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে দেখা গেলেও অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়না। যৌথ নদ-নদীগুলোকে প্রতিবেশী দেশের স্বেচ্ছাচারিতার উপর ছেড়ে দিয়ে, দেশের কোটি কোটি মানুষকে প্রকৃতির রুদ্ররোষের মুখে রেখে দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। বিশেষত নদীভাঙন রোধ ও নদীব্যবস্থাপনায় কার্যকর উদ্যোগ ছাড়া তথাকথিত উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের কোন লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন