আমাদের দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বলতে সাধারণত ধান-চাল উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা বোঝায়। সরকারের তরফ থেকেও স্বয়ংসম্পূর্ণতার বিষয়টিকে এরূপই ধরা হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ধান-চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলা হলেও বিদেশ থেকে হরদম চাল আমদানি করা হচ্ছে। এই আমদানি কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না। এর ফলে বিষয়টি স্ববিরোধী হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন উঠছে, খাদ্যে যদি আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণই হই, তবে চাল আমদানি করতে হবে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। এদিকে সরকার দেশের ধান-চাল উৎপাদনকারী কৃষকের কথা মাথায় রেখে চাল আমদানির উপর আরও ১০ ভাগ শুল্ক আরোপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে আমদানি খরচ বেড়ে যায়। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, যেখানে ধান-চালের বাম্পার ফলন হচ্ছে, সেখানে চাল আমদানি এবং শুল্কবৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা কি? বন্ধ করে দিলেই তো হয়। প্রতি বছরের মতো এবারও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে এই বাম্পার ফলন কৃষকের মনে আনন্দ জাগাতে পারছে না। ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার আশঙ্কায় তাদের দুঃখিত করে তুলছে। গতকাল বেশ কয়েকটি পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কৃষক হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যে ফসল ফলিয়েছে, তা বিক্রিকালে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার আশঙ্কায় তারা দুঃখের সাগরে ভাসছে। লাভ দূরে থাক প্রতি একর জমিতে ধান ফলাতে যে খরচ হয়েছে, তাই পাওয়া যাবে না। বোরো ধানের সবচেয়ে বড় আবাদি অঞ্চল কিশোরগঞ্জের হাওর, চলনবিল, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষক এখন দুশ্চিন্তায় আছে। তারা মনে করছে, এবারও তাদের উৎপাদন খরচ উঠবে না।
প্রতি বছরই ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া নিয়ে কৃষকদের মধ্যে হাহাকার দেখা যায়। এবারও এই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য, কৃষক তার সর্বোচ্চ শ্রম ও আন্তরিকতা দিয়ে ধান চাষ করে। এক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতাও অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। বিগত বছরগুলোতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা না দেয়ায় ধান উৎপাদনে রেকর্ড হয়েছে। খাদ্য মওজুদ গড়ে তুলতে সরকারের তরফ থেকেও ধান-চাল কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য মণপ্রতি মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়। দুঃখের বিষয়, ধান-চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের মূল কারিগর কৃষকদের জন্য এ মূল্য কোনো বছরই যথাযথ হিসেবে বিবেচিত হয়নি। তাদের লাভ তো হয়ই না, উৎপাদন খরচও উঠে না। এ বছর এখনও সরকার ধানের মূল্য নির্ধারণ করেনি। আজ নির্ধারিত হতে পারে। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, এ বছর ধানের উৎপাদন খরচ বিবেচনা করে মূল্য নির্ধারণ করা হবে। আমরা প্রতি বছরই সরকারের তরফ থেকে মূল্য নির্ধারণের কথা শুনি। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, কৃষক এই মূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের মধ্যে চরম হতাশা দেখা দেয়। আমরা বিগত বছরগুলোতে, ন্যায্যমূল্য না পেয়ে রাস্তায় ধান ফেলে কৃষককে প্রতিবাদ করতে দেখেছি। তাদের এ প্রতিবাদেরও কোনো মূল্য পাওয়া যায়নি। ফলে হতাশ হয়ে পড়া কৃষক ধান উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তারা অন্য ফসল ফলানোর দিকে ঝুঁকে পড়ে। ইতোমধ্যে দেখা গেছে, গত বছর যে কৃষক ধান চাষ করেছিল, এ বছর সে ধান চাষ হয় কমিয়ে দিয়েছে, না হয় অন্য ফসল ফলিয়েছে। পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনেক কৃষক সবজি, ভুট্টা, তামাকসহ অন্য ফসল ফলানো শুরু করেছে। এর ফলে এবার গত বছরের চেয়ে প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ কম হয়েছে। গত বছর যেখানে ৪৮.৪০ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছিল, সেখানে এ বছর চাষ হয়েছে ৪৬.৬০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন খরচ না উঠা এবং ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়াই যে এর মূল কারণ, তা বোধ করি ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। তবে যেসব এলাকায় বোরো ধান উৎপাদন করা ছাড়া অন্য কোনো ফসল ফলানো যায় না, সেসব এলাকার কৃষকরা সবচেয়ে বেশি দুর্দশার মধ্যে পড়ে। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের কৃষক এ অবস্থার শিকার হয়। অন্য এলাকার কৃষকদের এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হয় না। তারা ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে অন্য ফসল উৎপাদনে মনোযোগী হতে পারে। এর ফলে প্রতি বছরই ধান উৎপাদনের হার কমছে। বলা বাহুল্য, উৎপাদন খরচ ও কৃষকের শ্রমের মূল্য না পাওয়াই তাদের অনাগ্রহী করে তুলছে। তার উপর স্বল্পমূল্যে চাল আমদানির বিষয়টি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে রয়েছে। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে ধান-চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয়টি যে হুমকির মুখে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই।
চাল আমদানির উপর উচ্চ শুল্কারোপ সরকারের একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। তবে এ সিদ্ধান্ত কৃষকের জন্য কতটা উপকারে আসবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ কথা একজন সাধারণ মানুষও জানে, ধান-চালে উদ্বৃত্ত দেশে যখন চাল আমদানি করা হয়, তখন কৃষক বঞ্চিত হবেই। কৃষককে এ বঞ্চনা থেকে মুক্ত করতে পারে কেবলমাত্র আমদানি বন্ধ করা। নিদেনপক্ষে ধানের মৌসুমে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া। এর পাশাপাশি সরকারিভাবে ধান-চাল কেনার ক্ষেত্রে কৃষকবান্ধব মূল্য নির্ধারণ করা। এটা যদি ভর্তুকি দিয়েও হয়, তবে তাই করা উচিত। সরকারের দায়িত্ব কৃষকের উৎসাহ-উদ্দীপনা ও বাম্পার ফলনে মুখের হাসি ধরে রাখা। উৎপাদিত ধান-চাল ‘আমদানি’ নামক ইঁদুর দিয়ে খাওয়ানো কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তাই কৃষকের আগ্রহ ধরে রাখতে চাল আমদানি থেকে যেমন সরে আসতে হবে, তেমনি সরকারকে অবশ্যই কৃষকের উৎপাদন খরচ বিবেচনা করে ধানের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান-চাল ক্রয়েরও সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন