শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সবার জন্য মানবাধিকার ও সমতা নিশ্চিত করতে হবে

প্রকাশের সময় : ২৪ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

‘বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতি (জানুয়ারি-মার্চ), ২০১৬’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু তুলে ধরে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ বলেছে, গত তিন মাসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তিনগুণ বেশি। অধিকাংশ একক ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিন মাসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১০ জন নিহত ও ৩৬৬ জন আহত হয়েছে। ১০ জন অপহৃত হয়েছে। এদের মধ্যে দু’জন জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও আটজন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। জমি-জমা, ঘর-বাড়ি, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, দখল ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ৬৫৫টি। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অভিযোগ করেছেন, শুধু ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আট হাজার ২৫০টি। মূলত, এসব ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের নেতাকর্মীরা জড়িত ছিল। কিছু পরিবারকে দেশ ত্যাগের হুমকি দেয়া হয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আলোচনায় যাওয়ার আগে জানানো প্রয়োজন যে, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতি দেশের তাবৎ জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতি থেকে আলাদা কিছু নয়। দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি যে অত্যন্ত নাজুক ও উদ্বেগজনক, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতি সংক্রান্ত প্রতিবেদন এবং দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠনগুলোর রিপোর্ট থেকে তা স্পষ্ট এবং সকলেরই জানা। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ শুধুমাত্র সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে। বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতি এড়িয়ে গেছে। আলোচ্য রিপোর্ট থেকে বুঝা যায়, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব ঘটনা ঘটেছে তার পেছনে সাম্প্রদায়িক মনোভাব বা বিদ্বেষ কাজ করেনি। কাজ করেছে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ, সামাজিক বিরোধ ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য। এই অভিন্ন কারণে গোটা দেশে অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা গত তিন মাসে ঘটেছে।
গত তিন মাসে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির যে ভয়াবহ রকম অবনতি ঘটছে, তা এ দেশের প্রতিটি মানুষ তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলে দিতে পারে। পুলিশ সদর দফতরের হিসাবে, গত তিন মাসে সারা দেশে নিহত হয়েছে ৮৬৫ জন (বেসরকারী হিসাবে নিহতের সংখ্যা দেড় হাজার)। দস্যুতা-ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩৪১টি, শিশু ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে ৪ হাজার ৪৬০টি, অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ১৮৩টি। বলা বাহুল্য, এর বাইরে রয়েছে ছিনতাই, রাহাজানি, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, সন্ত্রাস ইত্যাদি এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নামে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা। দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র তুলে না ধরে যখন কেবল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরা হয়, তখন এরকম একটি ধারণা তৈরি হতে পারে যে, দেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানবাধিকারই শুধু লংঘিত হচ্ছে। প্রকৃত বাস্তবতা যে তা নয়, বর্ণিত তথ্য-পরিসংখ্যান তার প্রমাণ বহন করে। এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ও বিজ্ঞজনের মনে কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন। সংগঠনটি শুরু থেকেই দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী, রাষ্ট্র ও সরকারকে টার্গেট করে বক্তব্য দিয়ে আসছে। এতে বহির্বিশ্বে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে এবং দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœœ হচ্ছে। সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে কারো কারো অভিযোগ রয়েছে, তারা সাম্প্রদায়িক বিভেদাত্মক বক্তব্য দিয়ে এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা বলে বিদেশে অভিবাসন সুবিধা লাভ করছেন কিংবা আত্মীয়-স্বজনের অভিবাসনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। বিষয়টি সরকারের আমলে আনা উচিত এবং এটা বের করা কোনো কঠিন কাজ নয়। এর পরও আমরা সংগঠনটির বক্তব্য ও রিপোর্ট যাচাই করে দেখার পক্ষে। সাম্প্রদায়িক মনোভাব বা কারণে যদি কোথাও সংখ্যালঘুদের পীড়ন, নির্যাতন, অবিচার, অনাচার, বঞ্চনা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে, অবশ্যই সরকারকে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। শত শত বছর ধরে এদেশে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করছে। কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ সাংবিধানিকভাবে এখানে কোনো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পায় না। নাগরিক হিসেবে সবাই সমান এবং সকলের স্ব স্ব ধর্ম পালন ও সংস্কৃতি অনুসরণের নির্বাধ অধিকার রয়েছে। কোনো কারণে কোথাও এর ব্যত্যয় ঘটলে উপযুক্ত প্রতিকারের ব্যবস্থাও রয়েছে। প্রকৃত বাস্তবতা এই যে, এদেশে কোনো কালেই কোনো ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘুরা বৈষম্য বা বঞ্চনার শিকার হয়নি। বর্তমানে তারা বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর তুলনায় অনেক বেশি ভালো অবস্থানে আছে। প্রশাসন, পুলিশ ও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক প্রভৃতি ক্ষেত্রে বহু গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। এত বেশি উচ্চ অবস্থানে এর আগে তাদের দেখা যায়নি। এই উচ্চ পদাধিকারীদের কারো কারো বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, সম্প্রদায়প্রীতি ও অবস্থানগত কারণে অতিরেক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ থাকলেও এবং বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর মানুষ এতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। এটা বৃহত্তম সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যগত উদারতার পরিচয় এও লক্ষ্য করা যায়, এদেশের বর্ণবিভাজিত হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা উচ্চ বর্ণের তাদের ক্ষুদ্রাংশের মধ্যে কখনো কখনো বর্ণবাদী চিন্তা ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবের অবশেষ লক্ষ করা গেলেও অধিকাংশের মধ্যে নেই। আর নিম্নবর্ণের লোকদের মধ্যে একেবারেই নেই এবং তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা সামাজিকভাবে দুর্বল, আর্থিকভাবে অবনত এবং শিক্ষা-দীক্ষায়ও পিছিয়ে। ক্ষেত্র বিশেষে তারাই অনেক সময় নির্যাতন, অত্যচার ও বঞ্চনার শিকার হয়। আর সেটারও বেশিরভাগের কারণ হয় ব্যক্তিগত ও সম্পত্তিগত, না হয় সামাজিক ও রাজনৈতিক। যে কোনো পর্যালোচনা, সমীক্ষা ও বিবেচনায় এদেশের সংখ্যালঘুরা অন্যান্য যে কোনো দেশের তুলনায় ভালো আছে। কতটা ভালো আছে, প্রতিবেশী ভারতের সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিরীক্ষণ করলেই তা উপলব্ধি করা যায়। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের বৃহত্তম সম্প্রদায়ই নানা দিক দিকে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। একটি নজিরই উল্লেখ করা যাক। এটা স্বাভাবিক ও সঙ্গত যে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রমে ইসলামের শিক্ষা ও মূল্যবোধেরই প্রাধান্য থাকবে। অথচ দেখা গেছে, পাঠ্যক্রমে ইসলামী বিষয়সমূহ সুচিন্তিতভাবে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। পাঠ্যক্রম থেকে কারা এসব বাদ দিয়েছে, সরকারের সেটা দেখা উচিত। এ নিয়ে ইতোমধ্যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। অন্যান্য দিকেও যথাযথ নজর রাখা উচিত যাতে বৃহত্তম সাম্প্রদায় কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার না হয় কিংবা অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ না হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মানবাধিকার ও সমতা সুরক্ষা করা সরকারের অপরিহার্য দায়িত্ব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন