শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ডেঙ্গু প্রতিরোধ কি অসম্ভব?

মীর আব্দুল আলীম | প্রকাশের সময় : ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে গেছে। অবশ্য এটা ডেঙ্গুর মৌসুমও। গত কয়েক বছর ধরে বর্ষা মৌসুম এলেই এই প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। চিকিৎসকরা বলছেন, থেমে থেমে বৃষ্টি আর জনসচেতনতার অভাবে এডিস মশার বিস্তার ঘটছে। এই মশার কামড়ে প্রতিদিনই শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। ক’দিন আগে একটি পত্রকায় দেখেছি, এডিস মশার কামড়ে আড়াই হাজারের বেশি ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এই তথ্য সরকারি হলেও বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ৩ হাজারেরও বেশি মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। নতুন করে আরও অনেকে আক্রান্ত হয়েছে। সেই হিসেবে সামনের দিনগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা যে বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। এদিকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্ব জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের দুই ভাগই অর্থাৎ ২৫০ কোটি লোক ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশ এই তালিকায় প্রথম সারিতে আছে। এ তথ্য আমাদের জন্য মোটেও শুভ নয়।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রথম প্রয়োজন জনসচেতনতা। ভীত না হয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার ওপর জোর দিতে হবে। মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। ব্যক্তি সচেতনতাই পারে মশাবাহিত এই রোগ থেকে রক্ষা করতে। ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে বাঁচতে হলে মশক নিধনে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে আরও সক্রিয় হতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সবাই সচেতন হলে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কোনো কঠিন কাজই নয়।
ডেঙ্গুসহ মশাবাহী রোগ প্রতিরোধে মশাকে সবার আগে বশ করতে হবে। ‘মোটেও নয় মশকরা, যায় না মশা বশ করা’! সত্যিই মশাদের বশ করা যাচ্ছে না। তাই দেশে ডেঙ্গুসহ মশাবাহী রোগ বাড়েই চলেছে। রাজধানী ঢাকায় দাবড়ে বেড়াচ্ছে মশার দল। মশককূল রাজধানীতে রাজত্ব কায়েম করেছে। এ মশা দুই সিটি কর্পোরেশনের সুনামে হুল ফুটাচ্ছে! যখন লিখছি, তখন মশার দল হুল ফুটাচ্ছে পায়ে, মুখে, গালে। মশার এ যাতনা উভয় সিটি কর্পোরেশনের জন্য মোটেও সুখকর নয়। এ বছর রাজধানীতে অন্যান্য বছরের তুলনায় মশার উৎপাত একটু বেশিই। এলাকার বাসিন্দারা এ জন্য ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের অবহেলাকে দায়ী করে।
ঢাকার রাজনীতিতে মশা সব সময়ই একটি বড় ইস্যু। ঢাকার অন্তত তিনজন মেয়রের জন্য বিড়ম্বনা ডেকে এনেছে এই ক্ষুদ্র অথচ ভয়ঙ্কর প্রাণি। সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার জন্য সুনামহানির কারণ হয় বেপরোয়া মশা। সাঈদ খোকন এমনকি মরহুম আনিসুল হকও মশা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন। খুদে এ প্রাণির বিড়ম্বনা কিন্তু অনেক। বিপদ না চাইলে দুই সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিদের কুম্ভকর্ণের ঘুম থেকে জাগতে হবে। মানুষ এখন মশার কাছে জিম্মি। এখানে ব্যর্থ হলে জনগণ তার জবাব দেয়ই দেয়। বিগত ইতিহাস থেকে তাই শিখেছি আমরা। আজকাল মশা যেভাবে কামড়াচ্ছে তাতে করে নির্বাচনের সময় কামড়ের জ্বালা বোধকরি সংশ্লিষ্টরা টের পাবেন। মশা অতি ক্ষুদ্র হলেও ক্ষমতার গদি নড়বড়ে করতে এর জুড়ি নেই। মশা নিধনে ব্যর্থ হয়ে অনেকে পড়েছেন বিপাকে।
প্রশ্ন হলো, মশা নির্মূলে কী করছে দুই সিটি করপোরেশন? ডিসিসি উত্তর ও দক্ষিণে মশা নিধনের জন্য এক হাজারের ওপর কর্মী কর্মরত আছে। নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫/৬ জন কর্মী আছে বলে পত্রিকায় জেনেছি। তাদের কাজ শুধু মশার ওষুধ ছিটানো। প্রতি বছর মশা নির্মূলে প্রায় ৫০ কেটি টাকা বরাদ্দ পায় দুই সিটি করপোরেশন। এত কিছুর পরও রাজধানীতে দিন দিন মশার প্রকোপ বাড়ছে কেন? এই বিপুল জনবল আর বিপুল পরিমাণ অর্থের সঠিক ব্যবহার হলেতো নগরীতে এভাবে মশা থাকার কথা না।
সমস্যা আছে অনেক। জেনেছি, লোকবল আছে, ঔষধ আছে তবে সে ওষুধ ঠিকঠাকমত ছিটানো হয় কিনা তার মনিটরিং নেই। এতো লোক সারা বছর কাজ করলে, এতো অর্থ ব্যয় করলে তো নগরীতে মশা জন্মানোর কথা না। মূল কথা হলো, যেখানে মশারা জন্ম নেয়, সেখানে ওষুধ পড়েই না। কর্মীরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমালে মশা তো বাড়বেই। পত্রিকায় মশা বাড়ার খবর ছাপা হলে কিছুটা দৌড়ঝাপ দেখা যায়। এভাবে নগরীর মশা নিধন হবে না। মশারা আয়েশেই হুল ফোঁটাবে সবার গায়ে। মশা নিধনের জন্য অর্থ ও জনবলের পাশাপাশি মনিটরিং দরকার। মশা নিধন করা না গেলে, এই মশার মাধ্যমে মারাত্মক রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে। এডিস মশাসহ অন্যন্য মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তা ভয়াবহ যন্ত্রণার কারণ হবে বৈকি! সুতরাং মশা নিধনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ন্যূনতম গাফিলতি চলবে না। আমরা এও মনে করি, সিটি কর্পোরেশনদ্বয়ের পক্ষে এ কাজ করা খুব সহজসাধ্য হবে না যদি না নগরবাসীর কাছ থেকে যথাযথ সহায়তা আসে। নগরবাসীর উচিৎ, নগর বসবাসযোগ্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত রাখার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। কর্তৃপক্ষীয় উদ্যোগ ও ব্যবস্থার পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতা ও নাগরিক দায়িত্ববোধই পারে এই নগরকে মশা মুক্ত রাখতে।
লক্ষ করা গেছে, সুনির্দিষ্ট কিছু অভিজাত এলাকা ছাড়া কোথাও ক্রাশ প্রোগ্রামের বাস্তবায়ন নেই, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। কারণ প্রায় দেড় কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত মহানগরে নাগরিকদের সব সুযোগ-সুবিধার প্রাপ্তি একই মানদÐে বিচার করা সম্ভব না হলেও অন্তত সার্বিক বিচারে কিছু কিছু বিষয়ে সব নাগরিকের প্রাপ্তিতে সমতা থাকা উচিত। কারণ দিনভর পরিশ্রম করে একটি নির্বিঘœ ও সুখকর রাত সবাই প্রত্যাশা করে। আমাদের মনে রাখা উচিত, বিশাল বিশাল অট্টালিকার বাইরেও এ মহানগরীতে প্রায় চল্লিশ লাখ লোক বস্তিতে বসবাস করে। সামর্থ্যহীন এ লোকগুলোর জীবন-যাপনের দায়ভার বহন করাই যখন কষ্টসাধ্য, সেক্ষেত্রে মশার উপদ্রব থেকে নিজেকে রক্ষার বিকল্প তাদের আর কীইবা থাকতে পারে। এ নগরীর রক্ষাকর্তারা কি তা কোনোদিন ভেবে দেখেছেন?
বলার অপেক্ষা রাখে না, মশা নিধনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিকল্পনা ও চিন্তা-ভাবনার অভাব যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে জবাবদিহিতা ও মনিটরিংয়ের অভাবও। কোথাও কোথাও ওষুধ ছিটিয়ে কিংবা ফগার মেশিন চালিয়ে মশা দমন আদৌ সম্ভব নয়। মশা দমন ও নিধন করতে হলে মশার প্রজননক্ষেত্রের দিকে সর্বাগ্রে দৃষ্টি দিতে হবে। গোটা শহর কার্যত ময়লা-আবর্জনায় ভাগাড় হয়ে আছে। রয়েছে মাইলের পর মাইল খোলা নর্দমা। দু’ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রায় তিন হাজার বিঘা ময়লা ফেলার জায়গা রয়েছে। এসব জায়গায় ফেলা ময়লা ঠিকমত পরিষ্কার করা হয় না। ময়লা ফেলার স্থানগুলো মশা প্রজননের একেকটা ‘উৎকৃষ্ট’ ক্ষেত্র। খোলা নর্দমাগুলোও যথাসময়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না। মশার বংশ বিস্তারে নর্দমাগুলোর বড় রকমের ভূমিকা রয়েছে। শুধু তাই নয়, দু’ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রায় তিন হাজার বিঘা জলাশয় রয়েছে এবং প্রায় প্রতিটি জলাশয়ই ময়লা-আবর্জনার স্তূপে পূর্ণ। এগুলোও মশার উৎস হিসেবে কাজ করছে। মশার প্রজননস্থলসমূহ অবারিত ও উন্মুক্ত রেখে মশা দমন ও নিধনে সফল হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হতে পারে না।
এ বছর রাজধানীতে অন্যান্য বছরের তুলনায় মশার উৎপাত বেশি। বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা এ জন্য সিটি কর্পোরেশনের কর্তাব্যক্তিদের অবহেলাকে দায়ী করেন। তাদের মতে, বছরের নির্দিষ্ট সময় ডিসিসি মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলোতে ওষুধ ছিটানো হয়। এতে মশার বংশবৃদ্ধি কম হয়। কিন্তু এ বছর তা করা হয়নি। ঘরে-বাইরে সব জায়গায় মশার অত্যাচার। চায়ের দোকানে বসলেই মশা কামড়াতে শুরু করে। এলাকার নর্দমাগুলোতে আবর্জনা জমে থাকে। ডিসিসি আবর্জনা নিয়মিত পরিষ্কার করে না। এলাকাবাসীও নিজের বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার রাখে না। তাই, মশারা রাতেও কামড়ায়, দিনেও কামড়ায়। আগে দিনের বেলা এরা আন্ডারগ্রাউন্ডে অর্থাৎ ম্যানহোলে আত্মগোপন করে থাকত। রাতে বেরিয়ে আসত। এখন দিনরাত সবসময়ই এদের সমান আনাগোনা। রাতে বরং এদের আনাগোনা থেকে বাঁচার জন্য মশারীর ভিতর আশ্রয় নেওয়া যায় কিন্তু দিনের বেলায় মানুষের দিবানিদ্রার অরক্ষিত অবস্থার সুযোগ নিয়ে দিব্যি হুল ফুটিয়ে দেয় মশা। অবাধে চুষে নেয় তাজা রক্ত। এরা কানের কাছে ভোঁ-ভোঁ শব্দ করে মানুষের ঘুমের বারোটা বাজায়।
প্রজনন ও উৎসস্থলেই মশার বংশ ধ্বংস করতে হবে। আবর্জনা দ্রæত অপসারণ করতে হবে। আবর্জনা ফেলার জায়গাগুলো সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং নিয়মিত ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ওই সব জায়গায় মশার জন্ম হতে না পারে। খোলা নর্দমাগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে, ওষুধ দিতে হবে যাতে সেখানে মশা জন্মাতে না পারে। একইভাবে জলাশয়গুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে, নিয়মিত ওষুধ ছিটিয়ে মশার লার্ভা মুক্ত করতে হবে। উৎসে মশা দমন ও নিধন না করে উড়ন্ত মশা দমন ও নিধন কার্যক্রম চালিয়ে ঢাকাকে মশামুক্ত করা যাবে না। সিটি কর্পোরেশনদ্বয়কে এই সত্য উপলব্ধি করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। ওয়ার্ড কমিশনারদের আরও দায়িত্বশীল ও সক্রিয় হতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন