রানা প্লাজা ট্রাজেডির তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেন ব্লুম বার্নিকাট বলছেন, সস্তা শ্রম নয়, শ্রমিকের কাজের নৈপুণ্যে যে পোশাক তৈরি হচ্ছে বিশ্বব্যাপী সেটার জনপ্রিয়তার কারণেই তৈরি পোশাক খাতের বিস্তার হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের সঙ্গে আছে এবং থাকবে। অন্যদিকে, তখন পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলছেন, কালো টাকা আর অপ্রদর্শিত অর্থ এক নয়। ভারত-মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশেও অপদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। জাতীয় অর্থনীতিতে আবাসন খাত শীর্ষক এক গোল টেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি আরো বলেছেন, বাংলদেশের উন্নয়নে বেসরকারি খাতের অবদান অনেক। যত রকম পুরস্কার আছে সব বেসরকারি খাতে দেয়া উচিত। রানা প্লাজা ট্রাজেডির প্রসঙ্গ ধরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, রানা প্লাজার মতো একটি খারাপ ঘটনা পুরো খাতকে কলংকিত করেছে। এরপরেও তো অনেক ভাল কারখানা রয়েছে। তিনি মনে করেন, পোশাক কারখানার সার্বিক মান নিশ্চিত করলে উৎপাদনশীলতা বাড়ে। এটা ব্যবসায়িক দিক দিয়েও লাভজনক এবং তা পরিসংখ্যানগতভাবে প্রমাণিত।
পরিকল্পনামন্ত্রী ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত আলাদা আলাদাভাবে কথা বললেও বিনিয়োগের প্রসঙ্গে উভয়েই অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে কথা বলেছেন। কার্যত, একটি টেকসই বিনিয়োগ পরিবেশের উপরই তারা উভয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। স্থিতিশীল উৎপাদনের পরিবেশ ধরে রাখতে হলে অবশ্যই সামগ্রিক পরিস্থিতি হতে হবে শিল্প বান্ধব। শিল্পবান্ধব পরিবেশের অন্যতম শর্ত বিনিয়োগের নিশ্চয়তা থাকা। বেসরকারি বিনিয়োগের অবাধ প্রবাহ থাকা। বিনিয়োগের নিশ্চয়তা কেবলমাত্র তাত্ত্বিকতার বিষয় নয়। এর সাথে সম্পর্ক রয়েছে আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার। বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশে বিনিয়েগের পরিবেশ সৃষ্টিতে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের বিকল্প নেই। বছরের শুরুতে ব্যবসায়ীদের অন্যতম প্রভাবশালী সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স তাদের রিপোর্টে বলেছে, বিনিয়োগ বাড়াতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকতে হবে। সব ধরনের পরিষেবা ও অবকাঠামো সুবিধা যাতে সহজে ও যৌক্তিক মূল্যে পাওয়া যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। কম সুদে ঋণ দিতে হবে, যাতে ব্যবসা পরিচালনার খরচ কম হয়। দেশের অর্থনীতিবিদ শিল্পোদ্যোক্তারাও মনে করেন, রাজনৈতিক সহিংসতা না থাকলেও এক ধরনের অনিশ্চয়তা এখনও বিদ্যমান। এ কারণে বাংলাদেশে আশানুরূপ বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগ নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। বিদ্যমান বাস্তবতায় ব্যবসায় করতে এসে অনেক ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। এ বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশ ছয় ধাপ পিছিয়ে গেছে। অন্যদিকে প্রবাসীদের জন্য বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে বলে বলা হয়েছে। প্রবাসীরা মনে করেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ে বছরে পর বছর চলে যায় এতে কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য আর আলোর মুখ দেখে না। বাস্তবত, এটাই দেশের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দেশী বা বিদেশী যে কোন বিনিয়োগ ঋণাত্মক ধারায়ই বহমান থাকবে। ইতোমধ্যে দেশে অসংখ্য অর্থ লোপাটের মতো বড় বড় কেলেংকারী ঘটেছে। বিদেশে অবাধে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটে চলছে। শত শত গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়েছে। বায়াররা অন্যদেশে চলে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের উদ্যোক্তারাও বিদেশে গার্মেন্ট কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের জন্য অনুকূল নয়, এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি বা অর্থনৈতিক উন্নতির যত চিত্রই দেখানো হোক না কেন প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে কিছু মানুষ ছাড়া সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল নয়। তাদের হাতে পর্যাপ্ত টাকা নেই। অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি জরুরি। কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে এসমস্যার সমাধান অসম্ভব। প্রয়োজন বাস্তব কর্মসূচী গ্রহণ। সরকারের কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য অবস্থান ছাড়া পুরো পরিস্থিতির উন্নতির আশা অর্থহীন। সংশ্লিষ্ট সকলে এ ব্যাপারে আন্তরিক হবেন -এটাই প্রত্যাশিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন