রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে গত শনিবার সকালে দুর্বৃত্তরা নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে শালবাগানের বটতলা এলাকায় তার বাসা থেকে ১০০ গজ দূরে তাকে হত্যা করা হয়। দুর্বৃত্তরা হত্যাকা- শেষে মোটর সাইকেলে করে পালিয়ে যায় বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে গত শুক্রবার নগরীর একটি অভিজাত হোটেল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এক ছাত্র ও এক ছাত্রীর জোড়া লাশ উদ্ধার করা হয়। এই তিন হত্যাকা-ের ঘটনায় রাজশাহী মহানগরীতে ব্যাপক উদ্বেগ ও আতংক সৃষ্টি হয়েছে। শান্তির নগরী হিসেবে খ্যাত রাজশাহীতে এই তিন হত্যাকা- নাগরিক নিরাপত্তার ভঙ্গুরতাকে স্পষ্ট করেছে। কেউই আর নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছে না। বিশেষ করে প্রফেসর রেজাউল করিমের হত্যাকা- নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে প্রফেসর রেজাউল করিম ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন ও নিরীহ প্রকৃতির। রাজনীতির সঙ্গে তার সংশ্রব ছিল না। শিক্ষকদের কোনো দলের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ছিল না। তিনি ছিলেন সংস্কৃতিমনস্ক একজন মানুষ। তার একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল। তিনি শিক্ষকতা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কাজেই নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। তার মত একজন মানুষকে কেউ হত্যা করতে পারে, এটা তার সহকর্মী, ছাত্র-ছাত্রী ও পরিচিত জনেরা বিশ্বাস করতে পারছেন না। কেন, কি কারণে দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যা করলো তা কেউ আন্দাজ করতে পারছেন না। তবে অতীতে বেশ কিছু হত্যাকা-ে বিশেষ করে জাপানি ও ইতালীয় নাগরিক হত্যাকা-, ব্লগার ও প্রকাশক হত্যাকা-ের যে ধরন লক্ষ্য করা গেছে, এ হত্যাকা-ের ক্ষেত্রেও সেই একই ধরন অনুসরণ করতে দেখা গেছে। এই বিবেচনায় এ হত্যাকা-কে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করা যাচ্ছে না। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ও ঠা-া মাথায় হত্যাকা-টি ঘটানো হয়েছে বলেই মনে হয়। আগের কতিপয় হত্যাকা-ের মতো প্রফেসর রেজাউল করিম হত্যাকা-ের দায়ও যথারীতি আইএস স্বীকার করেছে। দেশে আইএস নেই, সরকারের তরফে বারবার এ দাবি করার পরও আইএস’র দায় স্বীকার অব্যাহত আছে। আমাদেরও বিশ্বাস, দেশে আইএস’র অস্তিত্ব নেই। কিন্তু তার নামে কারা একের পর এক হত্যাকা- ঘটিয়ে চলেছে, এটা একটা বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর ও প্রকৃত ঘাতকদের খুঁজে বের করা সরকারের অপরিহার্য দায়িত্ব।
বিদেশী হত্যা, ব্লগার ও প্রকাশক হত্যা, আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা, যাজক, পুরোহিত ও ইমামের ওপর হামলা, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা ইত্যাদি ঘটনা একসূত্রে গাঁথা বলেই পর্যবেক্ষকদের ধারণা। তাদের মতে, দেশকে অস্থিতিশীল করা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা এবং দেশের ভাবমর্যাদা অবনমিত করার লক্ষ্যেই এ ধরনের হত্যাকা- ও হামলার ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এর পেছনে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র রয়েছে এবং পরিকল্পিত নীলনকশা অনুযায়ী এ সব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। বিভিন্ন সময় সরকারি মহল থেকেও এ ধরনের কথাই বলা হয়েছে। অথচ অধিকাংশ হত্যা ও হামলার ঘটনার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। হত্যাকারী-হামলাকারীরা অধরা রয়ে গেছে। বিভিন্ন মহল থেকে হত্যা ও হামলার ঘটনাগুলোর দ্রুত তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেফতারের তাকিদ দেয়া হলেও সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ ও আইন-শৃংখলা বাহিনী এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো কোনো সাফল্যই দেখাতে পারেনি। এই অপরাগতা ও ব্যর্থতা তাদের সক্ষমতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কেও প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। সরকার ইচ্ছা করলে, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে অনেক কিছু হয়। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও আইন-শৃংখলা বাহিনী অসাধ্য সাধন করতে পারে। এর প্রমাণের অভাব নেই। আলোচ্য ক্ষেত্রে ব্যত্যয় দেখা যাচ্ছে কেন, তার সদুত্তর নেই। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, বিদেশী হত্যাকা-, ব্লগার-প্রকাশক হত্যাকা- এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলার ঘটনাগুলোর তদন্ত, গ্রেফতার, বিচার ও শাস্তি দীর্ঘসূত্রতায় আটকে থাকার কারণে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। প্রকৃত দুষ্কৃতীরা একের পর এক ঘটনা ঘটাতে সাহস পাচ্ছে।
দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা ও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি যে অত্যন্ত নাজুক ও উদ্বেগজনক খুন, অপহরণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, নারী-শিশু নির্যাতন ইত্যাদির সয়লাব এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- তার সাক্ষ্য বহন করে। এতটা শংকাতংক ও নিরাপত্তাহীনতা এর আগে দেখা যায় নি। আইন-শৃংখলা বাহিনী ও সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। যদি তাই হয়, তাহলে গত তিন মাসে সরকারি হিসাবে ৮৬৫ জন খুন হলো কিভাবে, প্রায় সাড়ে তিনশ’ দস্যুতা-ডাকাতির ঘটনা ঘটলো কিভাবে, কিভাবে ঘটলো চার হাজার ৪৫০টি শিশু-নারী নির্যাতনের ও ১৮৩টি অপহরণের ঘটনা ? এই তিন মাসে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- ও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু এবং আইন-শৃংখলা বাহিনীর পরিচয়ে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা কতটা ঘটেছে, মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে। বস্তুতপক্ষে, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন অত্যন্ত সঙ্গিন ও এবং নিয়ে দেশে-বিদেশে উৎকণ্ঠার কোনো শেষ নেই। সরকারের দায়িত্ব নাগরিক নিরাপত্তা ও আইন-শৃংখলা সুরক্ষা এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করা। সরকার তা করতে পারছে না কেন, সেটাই খুঁজে বের করতে হবে। পর্যবেক্ষকদের মতে, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বশীলতার ঘাটতি আছে, সক্ষমতার অভাব আছে, আছে আন্তরিকতার কমতি। সরকার বিরোধী দল দমন, রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা সংহত করা নিয়ে যতটা ব্যস্ত, নাগরিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিয়ে ততটা তৎপর নয়। ততটা সক্রিয় নয় মানবাধিকার সংরক্ষণে। পর্যবেক্ষকদের এই অভিমত আমলে নিয়ে সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। যে কোনো মূল্যে সরকারকে নাগরিক নিরাপত্তা ও আইন-শৃংখলার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। নিরাপদ করতে হবে মানবাধিকার। আইনের শাসন ও সুবিচারের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে আর প্রফেসর রেজাউল করিমের মতো মানুষকে ঘাতকের শিকার হতে হবে না। আমরা আশা করবো, অবিলম্বে তার ঘাতকদের খুঁজে বের করে আইনামলে আনা হবে। এই সঙ্গে অতীতে সংঘটিত এ ধরনের প্রতিটি হত্যাকা-ের তদন্ত ও বিচার ত্বরান্বিত করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন