বাংলাদেশ তরুণদের দেশ। জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ তরুণ। এদের বয়স ২৪ বা তার নিচে। এটি অত্যন্ত সুখবর। এই সুখবর দিয়েছে ইউএনডিপি। প্রতিষ্ঠানটির এশীয়-প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ‘শেপিং দ্য ফিউচার: হাউ চেঞ্জিং ডেমোগ্রাফিকস ক্যান পাওয়ার হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি আজ প্রকাশিত হতে পারে। এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৫টি দেশের জনসংখ্যাভিত্তিক তথ্য, পরিবর্তনের ধরন এবং করণীয় সম্পর্কে প্রতিবেদনে বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষ রয়েছে ১০ কোটি ৫৬ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ। আগামী ১৫ বছরে অর্থাৎ ২০৩০ সালে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১২ কোটি ৯৮ লাখে, যা মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ হবে। প্রতিবেদনে এই জনসংখ্যাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হবে তার পরামর্শও দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, জনসংখ্যাতাত্ত্বিক এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে আরও বেশি ও ভালো কাজের সৃষ্টি করতে হবে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ করতে হবে উৎপাদনশীল খাতে। বিপুল এই তরুণদের কাজে লাগাতে না পারলে সমস্যাও দেখা দিতে পারে বলে প্রতিবেদনের মূল লেখক থাঙ্গাভেল পালানিভেল আশংকা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ বেকার। যুবক শ্রেণীর একটি অংশ মা-বাবার আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এরা কাজ চায়। যদি কাজ না পায় তবে সেটা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এ কথা অনস্বীকার্য, সুদীর্ঘকাল থেকেই বাংলাদেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি হয়ে রয়েছে তরুণ সমাজ। বাংলাদেশের আজকের যে অবস্থান, তার পেছনে এদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। বিশ্বের খুব কম দেশেই এমন সমৃদ্ধ তরুণ শ্রেণী রয়েছে। পশ্চিমা অনেক দেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে দিন দিন তরুণ শ্রেণী হ্রাস পাচ্ছে। এ নিয়ে তাদের দুঃশ্চিন্তার অন্ত নেই। বাধ্য হয়ে তাদেরকে তৃতীয় বিশ্ব বা উন্নয়নশীল দেশ থেকে তরুণদের আমদানি করে কাজে লাগাতে হচ্ছে। যে চীন তরুণদের ওপর ভর করে সমৃদ্ধির শিখরে, সেও আজ তারুণ্য সংকটে পড়েছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশে তরুণ শ্রেণী উপচে পড়ছে। কর্মসংস্থানের অভাবে এদের বৃহদংশই বেকার। অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বার্থে যে হারে কর্মসংস্থান হওয়ার কথা, তা বৃদ্ধির পরিবর্তে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী বছরে মাত্র ৬ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। অথচ প্রয়োজন বছরে ১৩ লাখ। সংস্থাটি বলছে, দেড় দশকের মধ্যে বাংলাদেশে এখন বেকারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এদের মধ্যে ৭৪ শতাংশই তরুণ-তরুণী। সরকারী এই সংস্থার হিসেবেই দেশে চরম বেকারত্বের চিত্র উঠে এসেছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বেকারত্বের প্রকৃত চিত্র এটি নয়। বাস্তবে এই চিত্র আরও ভয়াবহ। বেকারদের কাক্সিক্ষত মাত্রায় কর্মসংস্থান তো হচ্ছেই না, উপরন্তু কর্মরত অবস্থা থেকে বেকার হয়ে পড়া মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে তরুণদের কর্মসংস্থানের অন্যতম বড় উৎস গার্মেন্ট শিল্প খাত। এ খাত এখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন। শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর ইতোমধ্যে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর ফলে ১০ থেকে ১২ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। তারা যুক্ত হয়েছে লাখ লাখ কর্মপ্রত্যাশী বেকারদের মিছিলে। এর ফলে বেকারদের হতাশা বহুগুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেউ কেউ আত্মহননের মতো পথ বেছে নিচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা অহরহ বলা হলেও দেশে বেকারত্বের হারের সাথে তা কতটা সাজুয্যপূর্ণ, এ প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এটা অনেকটা কন্ট্রাডিক্টরি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স নিয়ে সরকারের অহংবোধ থাকলেও এ খাতের বর্তমান দুর্দশার কথাও সকলের জানা। শ্রমশক্তি রপ্তানি বিগত দশকগুলোর তুলনায় অনেকটা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। শ্রমশক্তি রপ্তানির বৃহৎ বাজার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শ্রমিক নিয়োগ ঋণাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। কোনো কোনো দেশ বাংলাদেশ থেকে লোক নেয়া প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে। এছাড়া সরকারের তরফ থেকে মালয়েশিয়ায় লাখ লাখ লোক নিয়োগের চুক্তি নিয়ে যে বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তা বলা হয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত আষাঢ়ে গল্পে পরিণত হতে দেখেছে মানুষ। এর উপর কর্মসংস্থানের প্রধান একটি উৎস যে বিনিয়োগ, তার করুণ দশার চিত্রও ধারাবাহিকভাবে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। কর্মসংস্থানের যে মূল ক্ষেত্রগুলো সেগুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে হতাশায় নুয়ে পড়া দেশের এই বিপুল তরুণ বেকার শ্রেণীর কর্মক্ষমতা ও সৃজনশীলতা যে খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না, তা একপ্রকার নিশ্চিত। দেশের জন্য তা বিরাট অপচয় হয়ে দেখা দেবে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ যথার্থই বলেছেন, জনসংখ্যাতাত্ত্বিক এই সুবিধা তিন দশকের মতো পাওয়া যাবে। এরপর বয়স্ক মানুষের হার বাড়বে। যথাসময়ে তরুণদের কাজে লাগিয়ে শ্রমশক্তির মান উন্নয়ন করতে না পারলে, এক সময় তারা রাষ্ট্রের বোঝায় পরিণত হবে।
একটা সময় আমাদের অধিক জনসংখ্যাকে বোঝা মনে করা হতো। এখন তা বোঝা নয়, অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই শক্তি আমরা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারছি কিনা? দেশের বেকারত্বের দিকে তাকালে বলা যায়, এ ক্ষেত্রে আমরা ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি। যুবশক্তিকে কাজে লাগাতে সরকারের যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, তার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। অর্থনীতির সুষম উন্নয়ন হচ্ছে না। বেকারত্বের হার কমাতে পর্যাপ্ত কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হচ্ছে না। কর্মসংস্থানের মূল উৎস হিসেবে পরিচিত গার্মেন্ট ও শ্রমশক্তি রপ্তানি খাত বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। এর উত্তরণের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। অথচ দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সবার আগে তরুণ শ্রেণীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা অপরিহার্য। সুযোগ পেলে আমাদের তরুণরা যে দেশের জন্য বিস্ময়কর অবদান রাখতে সক্ষম, তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। এই কর্মকাক্সক্ষী তরুণ শ্রেণীকে কোনোভাবেই বেকার অবস্থায় রেখে দেয়া যায় না। এদের কাজে লাগাতে হবে। কর্মসংস্থানের যেসব খাত অচলাবস্থার মধ্যে পড়েছে, সেসব খাত সচল করার পাশাপাশি বিনিয়োগের স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিনিয়োগ না হলে চাকরির যেমন সুযোগ সৃষ্টি হয় না, তেমনি আত্মকর্মসংস্থানও স্থবির হয়ে পড়ে। কাজেই অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা গতিময় করে তুলতে আমাদের অমূল্য সম্পদ তরুণ শ্রেণীকে কাজে লাগানোর সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তা নাহলে এই তরুণ সমাজ শুধু পরিবার বা সমাজের বোঝা নয়, রাষ্ট্রের বোঝায় পরিণত হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন