অবশেষে জ্বালানি তেলের দাম কমিয়েছে সরকার। অকটেন ও পেট্রলে লিটারপ্রতি ১০ টাকা এবং ডিজেল ও কেরোসিনে লিটারপ্রতি ৩ টাকা কমানো হয়েছে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে যাতে বলা হয়েছে, রোববার মধ্য রাত থেকে নতুন মূল্য কার্যকর হবে। এর পূর্ব পর্যন্ত প্রতি লিটার অকটেন ৯৯ টাকা, পেট্রল ৯৬ টাকা এবং ডিজেল ও কেরোসিন ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এর আগে গত ৩১ মার্চ ফার্নেস অয়েলের দাম কমানো হয় প্রতি লিটারে ১৮ টাকা। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ৪২ টাকায়। স্মরণ করা যেতে পারে, যখন দাম বাড়ানো হয় তখন অপরিশোধিত প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ছিল ১০০ ডলারের ওপর। বর্তমানে প্রতি ব্যারেলের দাম ৪৫ ডলারের নীচে। এর আগে দাম আরো কম ছিল। এক সময় ২৭ ডলার পর্যন্ত নেমে এসেছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের ব্যাপক দরপতনের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন মহলের তরফে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম কমানো বা মূল্য সমন্বয় করার জোর দাবি অব্যাহত ছিল। সরকার এতদিন দাম কমায়নি। সরকারের বক্তব্য ছিল : এ যাবৎ জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দেয়ার কারণে যে ঋণের বোঝা জমেছে এই সুযোগে তা কমিয়ে আনা হবে। এরপর জ্বালানি তেলের দাম কমানো হবে। জানা গেছে, কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রির ফলে গত অর্থবছরে বিপিসি ৫ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। চলতি বছরে লাভের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যেই বিপিসির লাভ হয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। এখনো বিপিসি লাভ করবে। বর্তমানে বিপিসি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি লিটার অকটেন ৫৫ টাকা, পেট্রল ৫০ টাকা, ডিজেল- কেরোসিন ৩৮ টাকা ও ফার্নেস অয়েল ৩৮ টাকা দরে কিনছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সব দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেই তার দাম বাড়ে। একইভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে সব দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও দাম কমে। আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ে তখন চটজলদি এখানেও দাম বাড়ানো হয়, কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে তখন এখানে দাম কমানোর ক্ষেত্রে গড়িমসি করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দিনকে দিন কমলেও এখানে পূর্বদাম বহাল রাখা হয়। অথচ বিশ্বব্যাপী দাম কমানো হয়েছে এবং প্রতিটি দেশই এই সুবাদে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে। যদি শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারের দামের নিরিখে অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্য সমন্বয় করা হতো, বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বিপিসি এযাবৎ যত টাকা লাভ করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি টাকার লাভ হতো অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক, জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দেয়ার কারণেই বিপিসির লোকসান ও ঋণ বেড়েছে, এটা সর্বাংশে সত্য নয়। নানা অনিয়ম-দুর্নীতিও এই ঋণ-লোকসান বাড়ার জন্য দায়ী। ব্যবসা ও লাভ করা সরকারের কোনো সংস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে পারে না। সেবা ও কল্যাণই তার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এ ক্ষেত্রে বিপিসির অবস্থান কোথায়, সেটা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। অনিয়ম-দুর্নীতির খেসারত যাতে জনগণকে না দিতে হয় তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
যাহোক, শেষ পর্যন্ত জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা হলেও কমানো হয়েছে, এটা যেকোনো বিবেচনায় ইতিবাচক। এমনিতেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বেশি। আরো বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। এমতাস্থায় জ্বালানি তেলের দাম কমানোয় পরিবহনসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রসমূহে শুভ প্রভাব পড়বে বলে আশা করা যায়। খাতওয়ারী ব্যবহারের খতিয়ান থেকে দেখা যায়, জ্বালানি তেল সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় পরিবহন খাতে; ৪৫ শতাংশ। ২৫ শতাংশ ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। কৃষি খাতে ব্যবহৃত হয় ১৯ শতাংশ। শিল্প খাতে ৪ শতাংশ। গৃহস্থালি ও অন্যান্য খাতে ৭ শতাংশ। সঙ্গতকারণেই সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে পরিবহন খাতে। আনুপাতিক হারে পরিবহন ভাড়া কমলে যাত্রীসাধারণ যেমন স্বস্তি বোধ করবে তেমনি মালামাল পরিবহনে ব্যয় কমলে মালামালের দামেও তার ইতিবাচক প্রভাব দেখা দেবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় কমবে। গ্যাসের সাশ্রয় হবে। ফলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম কমানোর প্রসঙ্গ সামনে আসবে এবং কমানো হলে গ্রাহকসাধারণ উপকৃত হবে। অনুরূপভাবে কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রেও উৎপাদন ব্যয় কমবে, পণ্যের দামে যার প্রতিফলন ঘটবে। প্রশ্ন হলো, যেভাবে আশা করা হচ্ছে, সবকিছু কি সেভাবেই ঘটবে? এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে সবাই যাতে ন্যায়সঙ্গত বেনিফিট পায় তা সরকারেরই নিশ্চিত করতে হবে। আমরা আশা, করি জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাসের সুবিধা অর্থনীতিতে পড়বে, যা অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরো কমতে পারে, এমনকি প্রতি ব্যারেল ২০ ডলারে নেমে আসতে পারে। এটা শতভাগ জ্বালানি তেল আমদানিনির্ভর দেশের জন্য সুখবর। বাংলাদেশ সে রকমই একটি দেশ। এদিকে খেয়াল রেখে মূল্য সমন্বয়ের ব্যাপারটিও সক্রিয় বিবেচনায় রাখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন