শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বোরো আবাদ হ্রাস খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকি

প্রকাশের সময় : ২৭ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সারাদেশে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রায় বড় ধরনের ধস নামার খবর পাওয়া যাচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশী ধান উৎপাদন এবং বাম্পার ফলনের পরও উৎপাদন খরচ না ওঠায় বার বার লোকসান দিয়ে ধান উৎপাদন করায় কৃষকের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে কৃষক ধানচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে বলে আমরা বিভিন্ন সময়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছি। অবশেষে তা’ই ঘটল। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, চলতি মওসুমে বোরো ধানের আবাদ গৃহীত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ লাখ হেক্টর। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লোকসান সত্ত্বেও লক্ষ্যমাত্রা শুধু অর্জিতই হয়নি, প্রায় প্রতিবছরই লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশী বোরো আবাদ হয়েছে। এবারের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত, এবার বোরো আবাদ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় সোয়া লাখ হেক্টর কম হয়েছে। বোরো ধান চাষে কয়েক দশকের মধ্যে সম্ভবত এটি সবচে বড় বিপর্যয়। লোকসানের মুখে দেশের প্রধান খাদ্য ধানচাষের আগ্রহ হারিয়ে কৃষকরা এখন ভুট্টাসহ রবি ফসলের দিকে ঝুঁকছে। উত্তরাঞ্চলের অনেক ধানিজমি এখন লাভজনক তামাক চাষের আওতায় চলে যেতে শুরু করেছে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি অর্থনীতির জন্য এটি একটি অশনি সঙ্কেত।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কোন একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট পরিকল্পিত উপায়ে দেশের খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের সঙ্কট সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতে চায়। গত কয়েক বছর ধরে বোরো ও আমনের ভরা মওসুমেও ভারত থেকে লাখ লাখ টন চাল আমদানী করে উৎপাদিত ফসলের বাজার মূল্যে বড় ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করতে দেখা গেছে। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হলেও চাল আমদানীর অনুমতি পেতে কথিত সিন্ডিকেটের কোন সমস্যা হয়নি বলেই অভিযোগ রয়েছে। এভাবেই কৃষকদের লোকসানের মুখে ফেলে, মনোবল ভেঙে দিয়ে ধান-চালের উদ্বৃত্ত থেকে খাদ্য ঘাটতির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ধানের উৎপাদন ও খাদ্য ঘাটতির হাত ধরে আসবে খাদ্য আমদানী ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্যিক মুনাফাবাজি। সরকারী হিসাবে চলতি বোরো মওসুমে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় সোয়া লাখ হেক্টর ঘাটতি দেখানো হলেও ভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে বোরো আবাদ ও উৎপাদন আরো অনেক কম হয়েছে বলে জানা যায়। গত আমন মওসুমেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অন্তত ৬ লাখ টন উৎপাদন কম হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। বোরো আবাদে লক্ষাধিক হেক্টর জমির ঘাটতির কারণে সামগ্রিক খাদ্য যোগান ব্যবস্থায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাস্তবতায় নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর কৃষি জমি অনুৎপাদনশীল খাতে চলে গেছে। বিশ্বখাদ্য সংস্থ া(ফাও), ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউএসএইডের অর্থায়নে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে কৃষিজমি ছিল ৯৭ লাখ ৬১ হাজার হেক্টর। এরপর ২০০০ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে কৃষিজমি ৩ লাখ ২১ হাজার ৯০৯ হেক্টর কমে ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ হেক্টরে দাঁড়ায়। অর্থাৎ পরবর্তী এক দশকে কৃষিজমি হ্রাসের হার আগের ২৫ বছরের তুলনায় ৫গুণ বেশী। একটি জনবহুল কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশের জন্য এটি একটি বড় ধরনের আশঙ্কার বিষয়। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ব্যাপক সেচ সুবিধা, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আধুনিক কৃষিব্যবস্থা ও হাইব্রীড বীজের উপর ভর করে ইতিমধ্যে খাদ্য উৎপাদন দু’তিন গুণ বাড়ানো সম্ভব হলেও তা’ দীর্ঘদিন ধরে রাখা অসম্ভব। জমির উর্বরতা হ্রাস, জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা ও বন্যার কারণে ফসলহানি ঘটতে পারে যে কোন মওসুমে। তবে অনাকাক্সিক্ষতভাবে ভারত থেকে চাল আমদানীর মাধ্যমে ধান-চালের দরপতন নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে ধান উৎপাদনে কৃষকদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলার বাস্তবতা দুঃখজনক। ধান উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু। খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে আমদানীকারক এবং মধ্যস্বত্ব ভোগীদের সিন্ডিকেটেড নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়ার দুঃখজনক বাস্তবতা থেকে দেশের কৃষক ও কৃষিব্যবস্থাকে বাঁচাতে হবে। বিশেষত, ধান উৎপাদনে কৃষকের অর্থনৈতিক স্বার্থ অক্ষুণœ রাখতে ভর্তুকি বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষক পর্যায়ে ধানচালের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন