বিশ্বের অনেক আধুনিক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের এমন দাবির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গত সোমবার রাজধানীর কলাবাগানে বাড়িতে ঢুকে দুই ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহতদের একজন জুলহাস মান্নান ইউএসএআইডি’র কর্মকর্তা ছিল। সে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাত ভাই এবং সমকামীদের অধিকারে সোচ্চার রূপবান নামে একটি সাময়িকীর সম্পাদনায় যুক্ত। ইউএস স্টেট বিভাগ, ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এবং এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ হত্যাকা-ের নিন্দা জানিয়েছে। নৃশংস হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। তিনি এ হত্যাকা-ের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইকবাল মনে করেন, জঙ্গীরা এ হত্যাকা-ের সাথে জড়িত। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার জানিয়েছেন, তদন্ত শেষ না হলে বলা যাবে না ঘটনায় জঙ্গী সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা। তবে তিনি মনে করেন, এ হত্যা পূর্ব নির্ধারিত ও পূর্ব পরিকল্পিত। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের নববর্ষবরণের এক বর্ণাঢ্য মিছিলের নেপথ্যে ছিল আলোচ্য জুলহাস। এবছর পুলিশ এধরনের র্যালি নিষিদ্ধ করে। জুলহাস বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছিল সে হুমকি পেয়েছিল। এদিকে ঐদিন সকালে গাজীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকের সামনে এলপিআরে থাকা সার্জেন্ট ইন্সপেক্টর মো রুস্তুম আলী হাওলাদার এবং চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় মো. মনজু ও মো.কাশেমকে বাড়ি থেকে অপহরণের পর গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তরা। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় একই দিন সকালে মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার সময়ে দুই ভাইয়ের উপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা করে দুর্বৃত্তরা। এ সময়ে ঘটনাস্থলে একভাই সাবেক স্কুল শিক্ষক মজিবর রহমান নিহত হন। অপর ভাই গুরুতর আহত হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এর দু’দিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষককে দিনের বেলায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও একমাস আগে কুমিল্লা সেনানিবাসে মেধাবী ছাত্রী তনুকে হত্যা করা হয়েছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, গত কিছুদিন থেকে যেন পাল্লা দিয়ে দেশী-বিদেশী নাগরিক হত্যা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মহল যাই বলুক নাগরিক উৎকন্ঠা সৃষ্টিকারী সব চাঞ্চল্যকর হত্যা ঘটনার একটিরও কোন কূল-কিনারা করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ইতালীয় নাগরিক হত্যা থেকে শুরু করে সর্বশেষ হত্যাকা- পর্যন্ত প্রতিটি হত্যাকা- পর্যালোচনা করলেই দেখা যাচ্ছে, হত্যার পর অনেক ধরনের কথাবার্তা শোনা যায়। এমনকি নানা ধরনের গ্রেপ্তারের খবরও প্রকাশিত হয়। বাস্তবে কিছু হয় বা হয়েছে এমন কথা বোধহয় বলার মত কোন তথ্য-উপাত্ত নেই। সদাজাগ্রত প্রহরার মধ্যেই খুন হয়েছিলেন ইতালীয় নাগরিক। অনেরকেই তা দেখেছেন। আজ পর্যন্ত কোন সুরাহা হয়নি। অনুমানভিত্তিক গ্রেপ্তারের মাধ্যমে সম্ভবত উদোর পি-ি বুুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই হয়নি। কলাবাগানের হত্যাকা- ও তৎ পরবর্তী সংশ্লিষ্ট যেসব রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে হত্যাকারীরা অত্যন্ত স্বাভাবিক গতিতেই স্থান ত্যাগ করেছে। এদের মধ্যে একজন নাকি রক্তাক্ত জামা পরিবর্তন করে সাদা জামাও পরিধান করেছে। হামলাকারী সন্দেহে একজনকে পুলিশ ধরার পর সে নাকি পুলিশকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ বছরে খুন হয়েছে ২৫ হাজার মানুষ। ২০১৫ সাল অবধি তিন বছরে গুম হয়েছে ১৮৮ জন যার মধ্যে লাশ মিলেছে মাত্র ৩২টি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪৫টি। এই যখন পরিস্থিতি তখন গতকালের প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার শুনানী চলাকালে সাক্ষ্য গ্রহণকালে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামী নূর হোসেন তার ঠোঁটে আঙ্গুল তুলে সাক্ষীদের চুপ থাকতে নির্দেশ দিয়েছে। সংগত প্রশ্ন উঠতেই পারে কোত্থেকে এরা এধরনের সাহস পায়? এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না বিদ্যমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণে এটা মনে হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, বিচার পাবার ক্ষেত্রে হয়ত কোন না কোনভাবে এক ধরনের সমতার অভাব রয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা দুর্বলদের আর সরকারি বা প্রভাবশালীদের বিবেচনা যেন এক বলে মনে হয় না। হয়ত সে কারণেই দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন অবনতিতে এবং এক শ্রেণীর নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যর্থতায় শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ থেকে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষও চরম উদ্বিগ্ন। এই উদ্বিগ্নতা যে সংগত বিবেচনা থেকে এসেছে তা প্রমাণ করে কলাবাগানের ঘটনাও। দেখা যাচ্ছে ঘাতকরা ভিন্ন পরিচয় দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেও ঘটনা ঘটিয়ে যাবার সময় বাড়ির দারোয়ানকেও আঘাত করেছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিরীহ পথচারীও আক্রান্ত হচ্ছে। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে কোন ঘটনার কূল-কিনারা না হওয়াতেই দিন দিন আস্কারা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে কেবল হত্যার ঘটনাই নয়, সামাজিক অনাচারের ঘটনাও উত্তরোত্তর বেড়েই চলছে। এসবই যে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টার নামান্তর সে কথাও নতুন করে বলার কোন প্রয়োজন নেই।
এক ধরনের আতংক-আশংকা যে দেশী-বিদেশী নাগরিকদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সেকথা এখন আর নতুন করে বলার কোন অপেক্ষা রাখে না। ঘটনায় কারা যুক্ত তা নিয়ে এযাবৎকাল বিতর্ক যতটা হয়েছে দায়ীদের গ্রেপ্তারে তার চেয়ে অগ্রগতি অনেক কম। একে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা না বলে কোন উপায় নেই। সেই সাথে একথাও সত্যি যে, পরিস্থিতি এমনটা চলতে থাকলে অবস্থার আরো গুরুতর অবনতি হতে বাধ্য। এসব ঘটনার বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। সংগতভাবেই নাগরিক নিরাপত্তা না থাকলে দেশী-বিদেশী কোন মহলই বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না। জীবনের চেয়ে ব্যবসাকে কেউ বড় করে দেখে না। বরং জীবনের নিরাপত্তা ভাবনাই সর্বাগ্রে। কলাবাগানের নিহতের পরিচয় সম্পর্কে বলা হয়েছে সে একজন সমকামী সমর্থক বা তাদের প্রকাশনার সম্পাদনার সাথে যুক্ত ব্যক্তি। এর সাথে হত্যার সম্পর্ক আছে কিনা সেটা তদন্ত সাপেক্ষ। তবে এটা বলা যায়, বিষয়টি একদিকে যেমনি তার ব্যক্তিগত অন্যদিকে এটাও বিবেচ্য বিষয় যে প্রতিটি দেশের সমাজ-সংস্কৃতি, মন-মানসিকতার সাথে তাল মিলিয়েই সকলকে চলতে হয়। সমকামিতা বা এধরনের বিকৃত সংস্কৃতি ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের সমাজেও এটা গ্রহণযোগ্য নয়।তবে তার অর্থ আইনকে হাতে তুলে নেয়া নয়। কোন বিবেচনাতেই হত্যা প্রক্রিয়া বা প্রবণতা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা প্রতিটি হত্যাকা-ের সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন