সবাই জানে সেই প্রাচীন প্রবাদ ‘ চিকিৎসা অপেক্ষা প্রতিরোধই শ্রেয়’। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আদি যুগে রোগ নিরাময়ের প্রধান উপায় বা সম্বল ছিল গাছ গাছড়া অর্থাৎ ভেষজ উপাদান বা হার্বস। প্রকৃতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে সকল রোগ নিরাময়ের উপাদান সমূহ। বর্তমান সময়ে সারা পৃথিবীতে ভেষজ ঔষধ দিনে দিনে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মানুষ যখন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ামুক্ত ভেষজ ঔষধ তথা হারবাল ঔষুধকে রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে বেছে নিচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির কল্যাণে দুনিয়ায় অগণিত জিনিসের সৃষ্টি করেছেন। এরকম কোটি কোটি সৃষ্টির মধ্যে মানব দেহের জন্য খুবই উপকারী ও ঔষুধি গুণে ভরপুর একটি ভেষজের সহজ-সরল প্রচলিত নাম ওলটকম্বল ।
আমরা যারা গ্রামে কিংবা শহরে বসবাস করি সকলেই খুব ভালোভাবে এই ওলটকম্বল গাছ চিনি। ইউনানি নাম: উলটকম্বল। ইংরেজি নাম: Devil’s Cotton. Botanical Name: Abroma agusta Linn.cwievi: Sterculiaceae.পরিচিতি: আমাদের দেশে ওলটকম্বল বেশ পরিচিত ভেষজ উদ্ভিদ। এই গাছ সাধারণত ৮ থেকে ১০ ফুট লম্বা হয়। বিভিন্ন বনজঙ্গলে প্রাকৃতিকভাবেই এটি জন্মে। এর অনেক ঔষধি গুণ থাকায় বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ জন্য বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ শুরু হযেচে। গাছ খুব বেশি মোটা হয় না, এটি অনেকটা এরন্ড গাছের মতো। এর কাঠ নরম ও ধূসর বর্ণের হয়। গাছের ছালে পাটের আঁশের মতো আঁশ থাকে,এ জন্য ইংরেজিতে এই গাছকে বলা হয়-Devil`s Cotton । এর ফুল গাঢ় মেরুন রঙের হয়ে থাকে। ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ ও পাকলে ধূসর বর্ণের হয়,আর এটি পাঁচ কোনাবিশিষ্ট হয়। ফলের ভেতরে কম্বলের মতো লোমশ পাঁচটি প্রকোষ্ঠে কালোজিরার মতো অসংখ্য বীজ সাজানো থাকে। গাছের ডাঁটা ও ছাল পানিতে ভিজিয়ে রাখলে বিজল সৃষ্টি হয়।
প্রাচীনকাল থেকেই ইউনানি আয়ূর্বেদিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিভিন্ন ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে ওলটকম্বল ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইউনানির চেয়ে আয়ূর্বেদিক শাস্ত্রে এর ব্যবহার অনেক বেশি। ওলটকম্বলের প্রধান ব্যবহার স্ত্রীরোগে। প্রায় ২০ প্রকারের স্ত্রীরোগে এটি ব্যবহৃত হয় বলে একে ‘‘প্রাকৃতিক গাইনি ডাক্তার হয়।
উপকারিতা: ওলটকম্বল মহিলাদের অনিয়মিত ঋতুস্রাব, অল্প ঋতুস্রাব,অধিক ঋতুস্রাব, ব্যথাযুক্ত ঋতুস্রাব, শ্বেতস্রাব, প্রসব-পরবর্তী অধিকস্রাব, জরায়ুপ্রদাহ, জরায়ুর দুর্বলতা, যোনিপ্রদাহ, সহবাসকালীন ব্যথা, কোমর ব্যথা, গর্ভের উৎপত্তি না হওয়া ও প্রস্রাবে জ্বালাপোড়ায় ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও পুরুষদের শুক্রমেহ.শুক্রস্বল্পতা ও বাত ব্যথায় বিশেষ উপকার পাওয়া যায়। রোগ অনুযায়ী ব্যবহার পদ্ধতি- রোগের নাম ব্যবহার্য অংশ মাত্রা ব্যবহার পদ্ধতি : রজঃকৃচ্ছ্র মূলের ছাল ৬০ গ্রাম প্রতিবার ২৫০ মি.লি পানিতে জ্বাল দিয়ে পানির পরিমাণ অর্ধেক হলে ছেঁকে সকালে ও বিকেলে সেব্য। ব্যথাযুক্ত ও অনিয়মিত ঋতুস্রাব মূলের চাল চূর্ণ ৩ গ্রাম মূলের চূর্ণের সাথে ১৫০ মি.গ্রাম গোলমরিচের গুঁড়া মিশিয়ে মাসিকের চার-পাঁচ দিন আগে থেকে প্রতিদিন একবার সেব্য। জরায়ূর দুর্বলতা ও যোনিপ্রদাহ শুকনো ছাল ১০ গ্রাম এর সাথে আশোকছাল-১০ গ্রাম, মুন্ডিফুল -৫ গ্রাম, মেহেদি পাতা-২ গ্রাম ,আধা চূর্ণ করে প্রতিবার ২৫০ মি.লি. পানিতে জ্বাল দিয়ে পানির পরিমাণ অর্ধেক হলে ছেঁকে সকাল ও বিকেলে সেব্য। এভাবে এক মাস খেলে ভালো ফল পাওয়া যায়। শ্বেতপ্রদর মূলের ছাল চূর্ণ ৩ গ্রাম সকাল-সন্ধ্যায় পানিসহ খালি পেটে সেব্য। সহবাসকালীন ব্যথা ও বুক ধড়ফড় করা- কাঁচা ছাল ১০ গ্রাম ছাল বেটে পানিতে গুলে কচলে ছেঁকে এর সাথে অর্জুন ছালের চূর্ণ ৫ গ্রাম অল্প চিনি মিশিয়ে শরবত করে দিনে দুইবার সেব্য। জরায়ূর স্থানচ্যুতি তাজা মূলের ছাল ৫ গ্রাম পিষে পানিতে মিশিয়ে সকাল-সন্ধ্যায় নিয়ে চিনিসহ সেব্য। প্রস্রাব জ্বাড়াপোড়া পাতার ডাঁটা তিন-চারটি ডাঁটা ছেঁচে ২৫০ মি.লি. পানিতে কচলিয়ে প্রয়োজনে সামান্য চিনি মিশিয়ে সকাল -বিকাল খালি পেটে সেব্য। পুরুষদের শুক্রক্ষয় ও শুক্রস্বল্পতা তাজা পাতার ডাঁটা তিন-চারটি ডাঁটা ছেঁচে ২০০ মি.লি. পানিতে কচলিয়ে এককাপ দুধ সামান্য চিনি মিশিয়ে সকাল-বিকেল খালি পেটে সেব্য। বার্ধক্যজনিত রোগ মূলের চূর্ণ ২০০ মি. গ্রাম চূর্ণের সাথে গোলমরিচের গুঁড়া মিশিয়ে পানিসহ দিনে দুইবার সেব্য।
সতকর্তা: * গর্ভকালীন সময়ে ওলটকম্বল ব্যবহার নিরাপদ নয়। * অধিক সেবনে এলার্জি দেখা দিতে পারে। এ ছাড়াও মাথাঘোরা, বুক জ্বালাপোড়া, পেটে ব্যথা ও অতিরিক্ত রক্তস্রাব দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসক-কলামিস্ট,মোবাঃ ০১৭১৬২৭০১২০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন