দেশে হারবাল ও ইউনানী চিকিৎসার নামে চলছে ব্যাপক প্রতারণা। একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি, হাকিম, কবিরাজ ও ডাক্তার সর্ব রোগের চিকিৎসক সেজে দীর্ঘদিন থেকেই সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে আসছে। তাদের চটকদার বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হয়ে ভেষজ ওষুধের নামে নকল ও ভেজাল ওষুধ সেবন করে মানুষ আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এক রোগ সারাতে গিয়ে তারা নানা জটিল ও কঠিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু হাজার অভিযোগ সত্তেও মানুষকে প্রতারণা করা ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলা এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।
জনবহুল এলাকাগুলোয় ভেষজ ওষুধের নামে অসাধু ব্যবসায়ী ও তথাকথিত চিকিৎসকেরা ফুটপাত ও দোকানে ব্যবসা জমিয়েছে। রাজধানীর ফার্মগেট, গুলিস্তান, গাবতলী, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, কাওরানবাজার, মিরপুর, পল্লবীতে ফুটপাতে ১০ টাকা থেকে ১০০ টাকা দামের এমন ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। মূলত দরিদ্ররা এসব ওষুধের ক্রেতা। অপরদিকে কলিকাতা হারবাল, দিল্লি হারবাল ইত্যাদি নামের দোকানে ভেষজ নাম দিয়ে ৯০০ থেকে ২০০০ টাকায় ওষুধ বিক্রি হয়। শনির আখড়া, সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকা, মেরুল বাড্ডা, মালিবাগ, মগবাজার, কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড অননুমোদিত এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কিছু কিছু ওষুধে স্টেরয়েড ক্যামিকেল ব্যবহার করা হয়, যা চিকন স্বাস্থ্যকে মোটা করতে ব্যবহার করা হয়। এসব ওষুধ সেবন করলে পরে রোগীর খাওয়ার রুচি বেড়ে যায় অনেক বেশি। সাথে সাথে স্বাস্থ্যমোটা হয়ে যায়। এর মূল কারণ, যে কোনো মানুষ যখন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন করে তখন তার শরীরে পানি জমে শরীর ফুলে যায়, এর পরিণতি ভয়াবহ হয়। জন্য দেশের অ্যালোপ্যাথিক জগতের অনেক বড় মাপের ডাক্তাররাও পারতপক্ষে কোনো রোগীকে স্টেরয়েড গ্রুপের ওষুধ দেন না। কিন্তু ইউনানী মতের যে সমস্ত কথিত ডাক্তার বা কবিরাজ রয়েছেন তাদের স্টেরয়েড গ্রুপের ওষুধ সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে তারা তাদের তৈরি ওষুধে হরহামেশাই এই ওষুধ ব্যবহার করছে। যা খেয়ে মানুষ মৃত্যুর পথে ধাবিত হচ্ছে।
হারবাল ওষুধ হরহামেশাই ব্যবহার হলেও জনমনে এ ওষুধ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে নানা কারণে। প্রথমত, হারবাল ওষুধটি যারা প্রস্তুত করে তাদের কাজের মান ও বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দ্বিতীয়ত, হারবাল ওষুধ নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম প্রচারণা। দেশে বৈধ হারবাল ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অবৈধভাবে চোরাই পথে ওষুধ সরবরাহ হয় অধিকহারে। বর্তমানে দেশে মোট ২৯৭টি ইউনানী এবং ১৯২টি আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ওষুধের মান যথাযথ নয় বলে সাধারণ্য ধারণা প্রচলিত রয়েছে।
চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে যৌনোদ্দীপক ওষুধ বিক্রির প্রচারণা আমরা রাস্তাঘাটে অহরহ দেখতে পাই। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রচারণার নানা অভিযোগ পাওয়া যায়। ভুয়া কবিরাজ বা ভেষজ চিকিৎসকের প্রতারণায় গ্রামগঞ্জের ভেষজ চিকিৎসা কলুষিত হচ্ছে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) দীর্ঘদিন ধরে ঔষধি উদ্ভিদ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করে আসছে। সংস্থাটির বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ সফল উদ্ভাবন হারবাল এন্টি ডায়াবেটিক টি‘ডায়াবিনো’, যা জারুল গাছের পাতা থেকে তৈরি এক প্রকার চা। এই গবেষণা পরিষদ আরো বেশ কিছু ঔষধি উদ্ভিদ নিয়ে কাজ করছে যেমন- অর্জুন, বাসক, নিম, যষ্ঠিমধু, শতমূলী, অশোক প্রভৃতি। বর্তমানে বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রী তৈরিতে যেমন- বডি লোশন, সাবান, শ্যাম্পু, চুলের কলপ, শেভিং ক্রিম ইত্যাদি প্রস্তুত করার ক্ষেত্রেও ব্যাপকহারে ঘৃতকুমারী ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক শিল্প নিয়ে প্রতারক ওষুধ প্রস্তুতকারক ও ভুয়া কবিরাজদের শাস্তির বিধান ও তা কার্যকর করতে হবে। যানবাহন ও রাস্তাঘাটে এ ধরনের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে ভেষজ ওষুধ প্রস্তুতকারকদের বিজ্ঞানসম্মত ওষুধ তৈরির দক্ষতা অর্জনে এবং আধুনিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভেষজ ওষুধ সংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি (ক্রনিক) রোগের চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকর। অথচ নিম্নমানের, নকল ও ভেজাল ওষুধ রোগীদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের হিসাবে দেশের ওষুধের বাজারের ২৫ শতাংশ ভেষজ ওষুধের নিয়ন্ত্রণে। দেশে আয়ুর্বেদ-ইউনানী ও হারবাল ওষুধ উৎপাদনকারী অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান আছে ৫শ’ উপরে। কিন্তু বিভিন্ন সূত্রের হিসাবে, এগুলোর বাইরে অননুমোদিত প্রতিষ্ঠান আছে কয়েক হাজার। হাঁপানি, চর্ম ও যৌন রোগ, বাত-ব্যথা, রং ফরসা করা ও মোটা হওয়ার জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষ ভেষজ ওষুধ সেবন করে। এরই সুযোগ নেয় তথাকথিত হারবাল চিকিৎসাকেন্দ্র। প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ।
অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি বা অল্টারনেটিভ মেডিসিন বিশ্বের সর্বত্রই স্বীকৃত। গাছগাছড়ার ভেষজ চিকিৎসা থেকে শুরু করে আকুপাংচার, হাইড্রোথেরাপি, অ্যারোমাথেরাপি ইত্যাদি ব্যতিক্রমী চিকিৎসা বিভিন্ন দেশে চালু আছে। হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ কিংবা ইউনানী পদ্ধতিতে চিকিৎসা তো অনেক দেশে সরকারিভাবে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেই দেয়া হয়। চিকিৎসার মূল লক্ষ্য রোগীকে সুস্থ করা। তা সম্ভব না হলে উপসর্গগুলো কমানো এবং অবশ্যই কোনো ক্ষতি না করা। তাই যে পদ্ধতিতেই চিকিৎসা দেয়া হোক না কেন, তার পেছনে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি। ভেষজ চিকিৎসা হলেও তা যথাযথ হতে হবে। এর পেছনে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। মনগড়া যা খুশি তাই করার সুযোগ কারও নেই। আমাদের দেশেও অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি চালু আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে একই সঙ্গে চালু আছে অপচিকিৎসা। বিশেষ করে ভেষজ বা হারবাল চিকিৎসার নামেই এসব অপচিকিৎসা করা হয় বেশি। রাস্তার ফুটপাত থেকে শুরু করে অলিগলিতে গজিয়ে ওঠা এক-দুই রুমের ‘চেম্বার’ থেকে এসব চিকিৎসা দেয়া হয়। ফুটপাতের ক্যানভাসাররা মানুষকে বোকা সাজিয়ে প্রতারণা করছে। জনগণকে এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। আয়ুর্বেদিক, ইউনানী ও ভেষজ ওষুধের বাজারের ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে ভুঁইফোড় ও অসাধু প্রতিষ্ঠান। তারা বিপুল অঙ্কের করও ফাঁকি দিচ্ছে। রাস্তা-ঘাটে ওষুধ বিক্রি করা বেআইনি। প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেউ ওষুধ খাওয়া বা বিক্রি করাও বেআইনি। ভেজাল ওষুধ বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে অভিযোগ করা হচ্ছে। কিন্তু তেমন কাজ হয়নি। রাস্তায় যারা ওষুধ বিক্রি করে তারা শক্তিশালী। না হলে তারা কীভাবে পুলিশ প্রশাসনের সামনে এই কাজ করছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন