ফিলিপাইনের জাতীয় তথ্যভা-ার থেকে সাত কোটি নাগরিকের আঙ্গুলের ছাপ চুরি হয়ে যাওয়ার চাঞ্চল্যকর খবর পাওয়া গেছে। ইন্টারনেট হ্যাকিং-এর মাধ্যমে সাতকোটি মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট চুরির এই ঘটনাকে সরকারী তথ্যচুরির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতীয় তথ্যভা-ারের এই চুরির ঘটনা দেশটিতে আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনের উপর বড় ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নির্বাচনে ভোটার আইডেন্টিফিকেশনের জন্য গড়ে তোলা তথ্যভা-ারে সংরক্ষিত আঙ্গুলের ছাপ অথবা নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য হ্যাক হয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। এটা সকল দেশের জন্যই একটা সতর্ক সংকেত। আমাদের দেশেও ভোটার আইডি কার্ডের জন্য তথ্যভা-ার গড়ে তোলা হয়েছে। এখন তারই আলোকে বায়োমেট্রিক সিম রেজিস্ট্রেশন চলছে। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে মোবাইলফোনের সিম নিবন্ধনের বিপদজনক দিকগুলো নিয়ে শুরু থেকেই বাংলাদেশে বিতর্ক চলছে। বিতর্কের কারণেই ইতিমধ্যে ঘোষিত সময়সীমা শেষ হলেও অর্ধেকেরও বেশী মোবাইলফোন সিম এখনো বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছে। সিম নিবন্ধনের সময়সীমা বাড়ানো হবেনা বলে ইতিপূর্বে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম ঘোষণা দিলেও সরকারের এসব ঘোষণার পরও নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর কোটি কোটি মোবাইল সিমকার্ড পুনঃনিবন্ধন বাকি থাকায় সময় বাড়ানো অবশ্যম্ভাবী বলে ধরে নেয়া যায়। সময়সীমার মধ্যে পুনঃনিবন্ধন করতে ব্যর্থ হলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার পরও বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধনে আঙ্গুলের ছাপ চুরি বা বেহাত হওয়ার বিপদ ও আশঙ্কা করছে কোটি কোটি মোবাইলফোন গ্রাহক। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালে এবং সরকারের পক্ষে রায় ঘোষিত হলেও সংশ্লিষ্ট মোবাইল গ্রাহকরা আস্বস্ত হতে পারছেন না বলেই মনে হচ্ছে।
ফিলিপাইনের জাতীয় তথ্যভা-ার থেকে সাত কোটি মানুষের আঙ্গুলের ছাপ চুরির ঘটনা বাংলাদেশের জন্যও একটি অশনী সংকেত। আঙ্গুলের ছাপ চুরি হওয়া ফিলিপাইনের নাগরিকরা এখন আগামী নির্বাচনে তাদের নামে জালভোট প্রদানসহ নানা ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির আতঙ্কে ভুগছে বলে জানা গেছে। আগে থেকে এ ধরনের আশঙ্কায় শঙ্কিত বাংলাদেশের নাগরিক, যারা বাধ্য হয়ে মোবাইলফোনের বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধন করেছেন অথবা নিবন্ধনের চিন্তা-ভাবনা করছেন তাদের জন্যও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি এ ঘটনায় বাংলাদেশের ন্যাশনাল আইডি কার্ডধারী সব শ্রেণীর সাধারণ নাগরিক নিজেদের সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা বোধ করছে। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য, সুইফ্ট কোড হ্যাক করে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে শতকোটি টাকা চুরির সাথে ফিলিপাইনের হ্যাকার ও ব্যাংকারদের সম্পৃক্ততা ধরা পড়েছে। যেখানে ক্রেডিটকার্ড জালিয়াতি থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ গোপনীয় সুইফ্ট কোডও নিরাপদ থাকছে না, সেখানে দেশের ১২ কোটি নাগরিকের একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদ আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে নানা ধরনের জালিয়াতি ও প্রতারণার শিকারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা মোটেও অমূলক নয়। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের সংশ্লিষ্টরা কি সর্বসাধারণের এই আশঙ্কা দূর করতে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নেয়া আঙ্গুলের ছাপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে?
বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধনের নিরাপত্তা ঝুঁকি সম্পর্কে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও নানা মাধ্যমে আলোচনা করেছেন। আর আমাদের তথ্য-প্রযুক্তি এবং তথ্যনিরাপত্তা ইস্যুসমূহের দুর্বলতাও নানাভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এহেন বাস্তবতায় প্রয়োজনীয় বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত না করেই সকল মোবাইলফোন গ্রাহকের জন্য বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা কতটা যুক্তিসঙ্গত সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। যে সব দেশ সরাসরি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের হুমকির মধ্যে রয়েছে, তেমন কোন পশ্চিমা দেশও বেসরকারী মোবাইলফোন অপারেটরদের হাতে নাগরিকদের আঙ্গুলের ছাপ নিরীক্ষণের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। বাংলাদেশেও বিগত জাতীয় নির্বাচনে ই-ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের চিন্তা-ভাবনা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত না হলেও হয়তো ভবিষ্যতে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হবে। ফিলিপাইনের পথ ধরে বাংলাদেশের নাগরিকদের মোবাইলফোন সিম নিবন্ধন অথবা ভোটার আইডি কার্ডের সার্ভার হ্যাক করে আঙ্গুলের ছাপ চুরির মধ্য দিয়ে ইলেকশনে ভোট কারচুপিসহ নাগরিকদের ইমপার্সনেট করে জমিজমা, ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক জালিয়াতির ঝুঁকিতে ঠেলে দেয়ার যে কোন আশঙ্কার বিপরীতে কার্যকর প্রতিরক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে। এমনিতেই আমাদের গণতন্ত্র এবং নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণ আস্থা হারাচ্ছে। এখন কোটি কোটি মানুষের ভোটার আইডি কার্ড ও আঙ্গুলের ছাপ বেহাত হয়ে গেলে এটি বড় ধরনের জাতীয় বিপর্যয় সৃষ্টির কারণ হতে পারে। ভবিষ্যতের নির্বাচনব্যবস্থাও আরো বিতর্কিত হয়ে পড়তে পারে। যেখানে ২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ২ কোটি নাগরিকের আঙ্গুলের ছাপ ও সামাজিক নিরাপত্তা নম্বর হ্যাক হওয়ার মত নজির রয়েছে সেখানে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হওয়ার পর বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধনের ঝুঁকি সম্পর্কে কেউই আশঙ্কামুক্ত হতে পারছে না। ন্যাশনাল আইডি কার্ড বা ন্যাশনালিটি আইডেন্টিফিকেশন কোডসহ আঙ্গুলের ছাপ সরকারের কাছে জনগণের অমূল্য আমানত। কোন বেসরকারী কর্পোরেট মোবাইলফোন অপারেটর কোম্পানীর হাতে এ আমানত ছেড়ে দেয়া যায় না। সাড়ে ১২ কোটি মোবাইলফোন সিম গ্রাহকের আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণের বিষয়টি নিঃসেন্দহে জাতীয় নিরাপত্তার একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প যেন অর্থনীতিসহ জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ নজরদারি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন