বাংলাদেশের অহংকার সুন্দর বনের রূপ, বৈচিত্র্য ও অসাধারণ গঠনপ্রকৃতির গুৃরুত্ব বিবেচনা করে জাতিসংঘের ইউনেস্কো এটিকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করে। বলা যায়, এটি এখন আর শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সারা বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের নিদর্শন। কয়েক বছর আগে প্রকৃতির সপ্তাশ্চর্য প্রতিযোগিতায় সুন্দরবনের ঠাঁই পাওয়া এর গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি করে। এ বনের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো, এটি বিশ্বের একমাত্র ডোরাকাটা বাঘ বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সদা চঞ্চল বিরল প্রজাতির চিত্রল হরিণের আবাসভূমি এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। যে দেশে এমন একটি ‘সুন্দর বন’ থাকে, সে দেশের গর্ব করার মতো আর বেশি কিছু লাগে না। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের এই গর্ব যেন ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে চাইছে কিছু দুষ্কৃতকারী। তাদের এই ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকানোর যেন কেউ নেই। আরও দুঃখের বিষয়, এই ধ্বংসযজ্ঞের সাথে শাসক দলের কতিপয় লোকজন জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এই শ্রেণীর লোকজন কর্তৃক গত এক মাসে চার দফা আগুনে সুন্দরবনের অসামান্য ক্ষতি সাধিত হয়েছে। সর্বশেষ গত বুধবার বিকাল ৩টার দিকে সুন্দরবনের পূর্ব চাঁদপাই রেঞ্জের তুলাতলা ট্যাংরার বিলে চতুর্থ দফা অগ্নিকা-ে বনের ১৫ একর ভূমির গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিস ও এলাকাবাসী আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও তা বনের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। অগ্নিকা-ের ঘটনা তদন্তে চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বনসংরক্ষককে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, যে কয়বার সুন্দরবনে আগুন লেগেছে প্রত্যেকটিকেই নাশকতা হিসেবে বলা হচ্ছে। তবে এই নাশকতার সাথে জড়িত একজনকেও এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
সুন্দরবন ধ্বংসের কাজ একদিনে বা হঠাৎ করেই শুরু হয়নি। সুদীর্ঘকাল ধরেই এই বনের ক্ষতি সাধনের কার্যক্রম চলে আসছে। এজন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা যেমন দায়ী, তেমনি বেসরকারি বিভিন্ন গোষ্ঠীও দায়ী। সুন্দরবনের এই ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। দেখে শুনে মনে হচ্ছে, দুষ্কৃতকারীরা বনটি পুরোপুরি ধ্বংস না করে নিরস্ত হবে না। বন ধ্বংসের বিভিন্নমুখী তৎপরতার ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। একে রক্ষার যেন কোনো অভিভাবক নেই। আমরা দেখেছি, সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর অপরিশোধিত তেলবাহী ট্যাংকারসহ প্রায় সব ধরনের নৌযান-এর ভেতর দিয়ে চলাচল করছে। বছর দুয়েক আগে শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে সুন্দরবনের যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তার ক্ষত না শুকাতেই নানা অনাচার ও আগুন দিয়ে পোড়ানোর তা-ব শুরু হয়েছে। সুন্দরবনের অদূরে রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে তো রীতিমতো তর্কযুদ্ধ চলছে। সুন্দরবন নিয়ে গবেষকরা বলে একরকম, সরকার বলে আরেক রকম। জাতীয় তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদ রক্ষাকারী কমিটির পক্ষ থেকে রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেও সরকারকে তার অবস্থান থেকে এক চুলও টলাতে পারেনি। সরকার একবাক্যে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না বলে সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে সুন্দরবনকে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়ার কর্মকা-। এই অগ্নিকা- যে নাশকতামূলক তাতে কারো মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। শুধু অগ্নিকা-ই নয়, প্রতিনিয়ত বিষ দিয়ে মাছ মারা, বাঘ-হরিণ শিকার ও গাছ পাচারসহ হেন কোনো অপরাধমূলক কর্মকা- নেই, যা ঘটছে না। সুন্দরবন ধ্বংসে এসব অপকর্মের সাথে কারা জড়িত তা স্পষ্ট করেই বলেছেন ‘সেভ দ্য সুন্দরবন’ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, বন সন্নিহিত লোকালয় বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জের শাসকদলের কতিপয় জনপ্রতিনিধি এবং তাদের আশ্রিত দুর্বৃত্তরাই এর সাথে জড়িত। ইতোমধ্যে গত ১২ ও ১৮ এপ্রিল দু’টি নাশকতামূলক আগুনের ঘটনায় শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতিসহ দলের স্থানীয় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে বনবিভাগ পৃথক দু’টি মামলা করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, শাসক দলের কিছু লোকজনের সাথে বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং স্থানীয় দুষ্টচক্রও এসব ঘটনার সাথে জড়িত। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, যেখানে শাসক দলের লোকজন ও বনরক্ষকদেরই রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কথা, সেখানে তারাই ভক্ষক হয়ে সুন্দরবন ধ্বংসে মরিয়া হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রের সম্পদ ধ্বংসের এমন অপকর্মের সাথে যারা জড়িত, তাদের রাষ্ট্রদ্রোহী ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! অথচ এদের কারো বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ দূরে থাক, টিকিটি পর্যন্ত স্পর্শ করা যায়নি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে, সরকার যেন জেনেবুঝে চুপ থেকে এসব অপরাধীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে।
সুন্দরবন যে বাংলাদেশের মানুষের অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে আছে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। দেশের ভূসম্পদ রক্ষা থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা এবং লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস হয়ে থাকা এই বন ধ্বংসের সাথে যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। বনের সংরক্ষিত বিশেষ এলাকায় লোক চলাচল ও সব ধরনের সম্পদ আহরণ বন্ধ করাসহ দুষ্টচক্রকে দ্রুত বিচার আইনের আওতায় আনা উচিত। বনে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করাসহ পুরো সুন্দরবনকে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে আনতে হবে। কেবল সংরক্ষিত বন ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, এটি যাতে আক্ষরিক অর্থেই সংরক্ষিত হয়, এ ব্যবস্থা করতে হবে। এর ন্যূনতম ক্ষতি হয়, এমন প্রকল্প হাতে নেয়া, আশপাশে ক্ষতিকর শিল্প-কারখানা গড়ে উঠা বন্ধসহ ভেতরে ধ্বংসাত্মক কর্মকা- প্রতিরোধ করতে হবে। সুন্দরবন রক্ষায় সরকারের গাছাড়া ভাব পরিহার এবং এর সুরক্ষায় সব ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে আমরা আশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন