শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহানগর

চট্টগ্রামে উঠতি অপরাধীদের দাপট নেপথ্য গডফাদারের ভুমিকায় তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা

প্রকাশের সময় : ৩০ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : রুবেল, মনির, রানা, রুবেল হোসেন ও আলাউদ্দিন। সবার বয়স ষোল থেকে আঠারোর মধ্যে। এ বয়সে এরা একাধিক ডাকাতি ছিনতাই করেছে। বুধবার ভোরে চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ থানার উত্তর কাট্টলী বেঁড়িবাধ এলাকায় ডাকাতির প্রস্তুতিকালে অস্ত্রসহ তারা ধরা পড়ে। এসময় গণপিটুনিতে নিহত হয় তাদের তিন সহযোগী। ওই তিনজনের দুই জনও তাদের সমবয়সী। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তারা গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি ডাকাতিও ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। তাদের টোকাই থেকে ঘাটশ্রমিক অতপর ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হয়ে উঠার কাহিনী শুনে হতবাক পুলিশ কর্মকর্তারাও।
আব্দুল্লাহ আল নোমান (২০), মো. ডালিম (২২), পারভেজ আহমেদ (২১) ও তারিকুল ইসলাম (২০)। গত ২৪ এপ্রিল দিনদুপুরে নগরীর বাদুরতলায় একটি মিনি বাসে উঠে ১৫ লাখ টাকা ছিনতাই করার ঘটনায় সিসিটিভির ফুটেজ দেখে ওই চারজনকে আটক করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে ছিনতাই করা ১০ লাখ ২০ হাজার টাকাও উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ জানায় ছিনতাইয়ের সময় আটক ওই চারজনের সাথে আরও ৫ জন ছিল, তারাও এদের সমবয়সী। আটক চারজন স্বীকার করেছে তারা নগরীতে আরও বেশ কয়েকটি বড় বড় ছিনতাই করেছে।
মহিম আজম চৌধুরী (২০), অনন্য বড়ুয়া রনি (১৯), সুমন গাজী (২১), মিজানুর রহমান (২০) ও তার স্ত্রী জেসমিন আক্তার জুঁই (২০)। ২১ এপ্রিল নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে অপরহণকারী চক্রের ওই ৫ সদস্যকে পাকড়াও করে পুলিশ। পুলিশ জানায় গত ১৩ এপ্রিল ইট বালু সিমেন্ট ব্যবসায়ী মো. সোহেলকে অপহরণ করে তারা। পরে জিইসি মোড়ের একটি পরিত্যক্ত একতলা বাড়িতে জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এর আগেও তারা একাধিক ব্যক্তিকে কৌশলে অপহরণ করে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করেছে।
চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলায় ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে অল্পবয়সী সন্ত্রাসীরা। অস্ত্র, মাদক ব্যবসাতেও এসব তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে। স¤প্রতি নগরীতে সংগঠিত বেশ কয়েকটি ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ ও দস্যুতার ঘটনায় যারা আটক হয়েছে তারা সবাই উঠতি বয়সী। অস্ত্র, ইয়াবাসহ ধরা পড়ছে কিশোর, যুবকেরা। পুলিশ বলছে চট্টগ্রামে উঠতি সন্ত্রাসীদেরই এখন দাপট চলছে।
র‌্যাব-পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের হয়ে এরা অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে। শীর্ষ অপরাধীরা এখন গডফাদারের ভূমিকায়। নেপথ্যে থেকেই তারা নতুন সন্ত্রাসীদের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করছে। আবার কোন কোন এলাকায় উঠতি সন্ত্রাসীরা নিজেদের মধ্যে গ্রæপ তৈরি করে অপরাধ করছে। কোন কোন ঘটনায় স্কুল কলেজে পড়–য়াদেরও অপরাধে জড়ানোর প্রমাণ মিলছে। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে, কিংবা নেশার টাকা জোগাড় করতে বাবা, মায়ের অজান্তে তারা ছিনতাই, ডাকাতিতের নেমে পড়েছে। এদিকে উঠতি সন্ত্রাসীদের দাপটে অসহায় হয়ে পড়ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর সদস্যরা। এসব অপরাধীদের সর্ম্পকে পুলিশের কোন ধারণা নেই। থানা পুলিশের খাতায় তাদের নামও নেই। ফলে কোথাও কোন অপরাধ হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়তে হয়।
পুলিশ ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, নগরীর বায়েজিদ থানা এলাকায় উঠতি সন্ত্রাসীদের দাপট বেশী। জমিদখল থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতির মতো অপরাধেও উঠতি বয়সের সন্ত্রাসীরা অগ্রগামী থাকছে। পেশাদার অপরাধীদের পাশপাশি রাজনৈতিক দলের ক্যাডার মাস্তানেরাও এসব ছেলেদের নিজেদের দলে ভিড়িয়ে অপরাধে নামিয়ে দিচ্ছে। বড় ভাইয়ের হুকুম তামিল করতে গিয়ে তারা খুনখারাবি পর্যন্ত করছে। নগরীর খুলশী, আকবর শাহ, সদরঘাট, চান্দগাঁও থানা এলাকায়ও উঠতি বয়সীদের বেপরোয়া তাÐব চলছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ এমন কোন অপরাধ নেই যাতে কিশোর যুবকেরা জড়িয়ে পড়ছে না। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নিজেদের সাম্রাজ্য ধরে রাখতে মূলত বড় অপরাধীরাই এসব উঠতি সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করছে। তাদের হাতে অস্ত্র দিচ্ছে। তুলে দিচ্ছে নেশার সামগ্রী। তারাও রাতারাতি টাকা পয়সা কামাই করতে বড় ভাইদের হুকুম তামিল করে চলেছে। কোন কোন এলাকায় নেশার টাকা জোগাড় করতে কিশোর যুবকরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিতেও এসব নবীন অপরাধীদের সক্রিয় দেখা যাচ্ছে।
আকবর শাহ থানার উত্তর কাট্টলী বেড়িবাঁধ এলাকায় ডাকাতি করতে গিয়ে পুলিশ ও জনতার হাতে আটক পাঁচ ডাকাত ছিল টোকাই। তাদের বয়স এখন ১৮ ছুঁয়েছে। তারা জানায়, টোকাই হিসাবে রেলস্টেশন, মাজার, বাজার, মাছের ঘাটে ছিল তাদের অবাধ বিচরণ। তারা কর্ণফুলীতে আসা নৌকা থেকে মাছ বোঝাই করে ঘাটে নেয়ার কাজ করতো। মাছ বোঝাইয়ের কাজ করতে গিয়ে পাঁচ টোকাই জড়িয়ে পড়ে দুর্ধর্ষ ডাকাত চক্রে। আকবর শাহ থানার ওসি সদীপ কুমার দাশ বলেন, তারা একসময় বিভিন্ন ধরনের ছোটখাট অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। একটি সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের নেতারা তাদের শনাক্ত করে নিজেদের দলে নিয়ে নেয়। এই চক্রটিই বেশ কয়েকদিন ধরে কাট্টলীর বিভিন্ন এলাকায় নিম্ন আয়ের লোকজনের বাসাবাড়ি, দোকানপাটে ডাকাতি করছিল।
ওসি জানান, বাড়ি দেশের বিভিন্ন জেলায় হলেও তাদের সবার জন্ম নগরীর সদরঘাট থানা এলাকায়। মাঝিরঘাট, বাংলোপাড়, আপেল মাঝির কলোনি, পুরাতন কাস্টমস এসব এলাকাতেই তাদের বসবাস। মনির, রানা, আলাউদ্দিন ও রুবেল নগরীর সদরঘাট থানার কর্ণফুলী ঘাটে সাম্পান থেকে মাছ বোঝাইয়ের কাজ করে। মো. রুবেল মাছ বোঝাইয়ের কাজের পাশাপাশি রিক্সাও চালায় বলে জানিয়েছে। মো. রুবেল জানান, গণপিটুনিতে নিহত সাগর ও রাসেলের সঙ্গে তাদের পরিচয় কর্ণফুলী ঘাটে। তারাও মাছ বোঝাইয়ের কাজ করত। পরে তারা তাদের দলে ভিড়িয়ে নেয়। টোকাই থেকে তারা হয়ে যায় ডাকাত দলের সদস্য।
গত ২৪ এপ্রিল নগরীর বাদুরতলায় একটি বাসে উঠে ১৫ লাখ টাকা ছিনতাই করে একদল ছিনতাইকারী। এ ঘটনায় ছিনতাইকারী চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- আব্দুল্লাহ আল নোমান, মো. ডালিম, পারভেজ আহমেদ ও তারিকুল ইসলাম। নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) পরিতোষ ঘোষ বলেন, গত ২৪ এপ্রিল বাদুরতলা এলাকায় বাসে উঠে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় গ্রেপ্তারকৃতরা। ছিনতাইয়ের শিকার দিদারুল আলমের করা মামলার প্রেক্ষিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গাড়ি থেকে ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার সময় পার্শ্ববর্তী একটি ভবনের সিসিটিভি ক্যামেরায় বিষয়টি ধরা পড়ে।
ওই ভবন থেকে সংগ্রহ করা ফুটেজেও গ্রেপ্তারকৃতদের দেখা গেছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, এই চক্রটির সাথে আরও কিছু লোক জড়িত আছে। তাদের গ্রেপ্তার ও বাকি টাকা উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। পরিতোষ ঘোষ বলেন, প্রথমে গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের দেয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আরও নয় লাখ ৯০ হাজার টাকার সন্ধান দেয়। দিদারুল আলম জানান, রোববার ব্রাক ব্যাংকের চকবাজার শাখা থেকে ১৫ লাখ টাকা তুলে তেলেপট্টি এলাকায় যান।
সেখান থেকে ১ নম্বর রুটের রাইডারে (হিউম্যান হলার) চড়ে বহদ্দার হাট মোড়ে তার ভাইকে টাকাগুলো দিতে যাচ্ছিলেন। বাদুরতলা এলাকায় রাইডারটি পৌঁছার পর কয়েকজন তাতে উঠে যায়। এসময় গাড়িতে থাকা তাদের বয়সী আরও কয়েকজনসহ আমাকে মারধর করে সাথে থাকা টাকার ব্যাগ নিয়ে মোটর সাইকেল যোগে পালিয়ে যায়। তিনি বলেন, এত কম বয়সী ছেলেরা যে এতবড় ছিনতাই করতে পারে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। জিজ্ঞাবাদে এসব সন্ত্রসীরা আরও কযেকটি ছিনতাইয়ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। স¤প্রতি নগরীতে একাধিক খুন, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় বেশ কয়েকজন উঠতি সন্ত্রাসী ধরা পড়ে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন