গত কয়েক বছরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহর, এমনকি গ্রাম পর্যায়েও উঠতি সন্ত্রাসীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সন্ত্রাসের জগতে তাদের দাপট ও আধিপত্য ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে। এদের গড় বয়স ১৬ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, মাদক ব্যবসার মতো ভয়ংকর অপরাধে তারা জড়িয়ে পড়ছে। তাদের গডফাদার হয়ে রয়েছে নেপথ্যে থাকা শীর্ষ অপরাধী ও সমাজের একশ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তি। তারাই এসব তরুণকে বিপথগামী করে তুলছে এবং তাদের দিয়েই এলাকার আধিপত্য বিস্তারসহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে। উঠতি বয়সী এসব সন্ত্রাসী তরুণ হওয়ায় যে কোনো অপরাধমূলক কাজ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে চট্টগ্রামে এমন উঠতি সন্ত্রাসীদের দাপটের কথা উঠে এসেছে। উঠতি সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া মনোভাবের কাছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। নতুন নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি হওয়ায় এবং তালিকাভুক্ত না হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও তাদের সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। ফলে কোথাও কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারছে না। তাদের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের তালিকায় খুঁজতে হয়। মাঝে মাঝে এসব উঠতি সন্ত্রাসী ধরা পড়লে বের হয়ে আসে তাদের সন্ত্রাসের সাথে যুক্ত হওয়ার নানা কাহিনী। কেউ টোকাই থেকে, কেউ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে, কেউ নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে সন্ত্রাসের সাথে জড়িয়ে পড়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যেমন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অন্যতম নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করছে, তেমনি সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও বেকারত্বের হতাশাও তরুণদের বিপথগামী করে তুলছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি এমনকি জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ তরুণদের এ অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে ব্যবহার করছে। এ কথা অনস্বীকার্য, যে কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপের পেছনে প্রভাবশালী কোনো না কোনো মহলের যোগসূত্র থাকে। নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও অবৈধ কর্মকা- নির্বিঘœ করতে তারা সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে তোলে। আমরা ময়মনসিংহের এক এমপির এইটটি বাহিনী গঠনের কথা পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি। কক্সবাজার ও ফেনীর জনপ্রতিনিধিদের বিভিন্ন বাহিনীর কথাও কারো অজানা নয়। আবার এ অভিযোগও রয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর সদস্য এসব বাহিনীকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। সমাজের একশ্রেণীর প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের মদদ ছাড়া দাগী হোক আর উঠতি হোক, কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপই গড়ে উঠা সম্ভব নয়। দেশে উঠতি সন্ত্রাসীদের আবির্ভাবের পেছনে এটি প্রধান কারণ বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা তরুণ সমাজের একটি অংশকে সন্ত্রাসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। এই ভারসাম্যহীনতা এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, একটি শ্রেণী অগাধ অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে গেছে, আরেকটি শ্রেণী প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেখা গেছে, প্রান্তিক পর্যায়ের তরুণ শ্রেণীই বেশি সন্ত্রাসের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের দারিদ্র্য এবং তারুণ্যের সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালীরা। দেশে যদি সুষমভাবে অর্থনৈতিক চাঞ্চল্য বজায় থাকে, পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, তাহলে যেসব তরুণ সন্ত্রাসের সাথে পা বাড়াচ্ছে, তাদের এ পথ থেকে নিবৃত করা যেত। এখন যে সব তরুণ সন্ত্রাসের সাথে জড়িয়ে পড়ছে, দেখা যাবে, এরাই একসময় শীর্ষ সন্ত্রাসীতে পরিণত হচ্ছে। আমরা এমন অনেক নজির দেখেছি, কেন্টিন বয়, কুলি, টোকাই থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়েছে। এ সময়ের উঠতি বা চিহ্নিত সন্ত্রাসীর পেছনের শক্তির কথা যদি বিবেচনা করা হয়, তবে শাসক দলের সাথে সম্পৃক্ত কোনো না কোনো নেতার মদদের বিষয়টি উঠে আসা অস্বাভাবিক নয়। এলাকার চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ আধিপত্য বিস্তারে উঠতি সন্ত্রাসীদের তারা ব্যবহার করে। ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে এই সন্ত্রাসীরাই হয়তো নতুন শাসক দলের লোকদের হয়ে কাজ করবে। সন্ত্রাসীদের ধর্মই এই, তাদের নির্দিষ্ট কোনো দল নেই। তারা বরাবরই ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় লালিত হয়।
উঠতি সন্ত্রাসীর সংখ্যা কেন বাড়ছে, এ বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। কেবল সন্ত্রাসী ধরলেই হবে না, তারা যাতে ছাড়া না পায় এবং শাস্তির মুখোমুখি হয় এ ব্যবস্থা করতে হবে। তরুণ শ্রেণী কেন সন্ত্রাসের সাথে জড়িয়ে পড়ছে, এর মূলে যেতে হবে। প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। পুলিশের খাতায় নাম নেই বলে উঠতি সন্ত্রাসীদের দমনে হিমশিম খেতে হবে, এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পুলিশকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে তরুণ শ্রেণীর ধরণ ও বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করে সে অনুযায়ী শৃঙ্খলাবৃত্ত গড়ে তুলতে হবে। শুধু শাসক দলের নেতা-কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করে এলাকার খবর নিলে হবে না, সমাজের সাধারণ মানুষের সাথেও যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে। এলাকায় কারা প্রভাবশালী এবং তাদের ভূমিকা কি, এ বিষয়গুলো নজরদারিতে রাখা অপরিহার্য। অভিভাবকদেরও তার সন্তানের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। সন্তান কোথায় যায়, কখন বাসায় ফেরে, কার সাথে মেলামেশা করে এসব বিষয় নিয়মিত খোঁজ-খবর নিতে হবে। পারিবারিক শাসন-বারণ এবং নীতি-নৈতিকতার মধ্যে সন্তানকে আবদ্ধ রাখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন