আমাদের দেশের রাজনীতিতে সংলাপের ইতিহাস সুখকর নয়। নিজেরা তো নয়ই বিদেশিদের মধ্যস্থতায়ও আমরা কখনো সংলাপ করে ঐকমতে পৌঁছতে পারিনি। ফলে সংকটের সমাধান সংলাপে না হয়ে অন্য পথে হয়েছে।
সংলাপ ১৯৭১: পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক সংকট। এই সংকট নিরসনের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনার জন্য। ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ থেকে শুরু হয়ে সংলাপ চলে ২৩ মার্চ পর্যন্ত। তখন প্রতিদিনই উভয় পক্ষে বলা হয় যে, আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে হয় উল্টো। আলোচনার নামে সময় ক্ষেপন করা হয়। আর এই সময়ের মধ্যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনতে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে সম্মত না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত মুজিব-ইয়াহিয়া সংলাপ চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়। পরে ২৫ মার্চের কালো রাতে চালানো হয় বর্বরোচিত হামলা। তারপর শুরু হয় প্রতিরোধ এবং ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ। আর তার মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর একমাত্র ২০০১ সালের নির্বাচন ব্যতীত অন্য সব নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং নির্বাচন নিয়ে মতপার্থক্য দেখা গেছে। এর আগ অন্তত তিনবার দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে আলোচনা বা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে দুবার হয়েছে বিদেশিদের মধ্যস্থতায়। কিন্তু সেসব আলোচনায় রাজনৈতিক সংকটের কোনো সুরাহা হয়নি।
সংলাাপ ১৯৯৪: ১৯৯৪ সালে মাগুরার একটি সংসদীয় উপ-নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আনে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সামনে আনে আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তারা জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলে। তার সাথে তখন যোগ দেয় জামায়াতে ইসলামী এবং সদ্য বিদায়ী জাতীয় পার্টি। টানা হরতাল এবং সহিংসতায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং গণতন্ত্র সংহত করতে কমনওয়েলথের তরফ থেকে আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়।
কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত হিসেবে ঢাকায় আসেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার স্টিফেন নিনিয়ান। টানা কয়েকদিন সংলাপ চলে। কিন্তু সে আলোচনাও সফল হয়নি। স্টিফেন নিনিয়ান তখন ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে দফায়-দফায় বৈঠক করেন। এক পর্যায়ে তিনি সর্বদলীয় একটি সরকার গঠনের প্রস্তাব করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সে সরকারে সরকার এবং বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের নিয়ে একটি মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া একজন টেকনোক্রেট মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবও দেন কমনওয়েলথ মহাসচিবের দূত। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে ফর্মুলা মানেনি। উল্টো স্যার নিনিয়ানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও তোলে। কোনো রকম সমাধানে না আসার কারণে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান মি: নিনিয়ান ।
সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ আন্দোলন আরো জোরদার করে এবং বিএনপি নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনের পর গঠিত সংসদ সংবিধান সংশোধনের করে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এর পর পরই সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই আবারো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
সংলাপ ২০০৬ : ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল সংসদ ভবনে সংলাপে বসেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশন সংস্কারের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ একটি প্রস্তাব তুলে ধরে। প্রথম দিনের আলোচনা শেষে বিএনপি মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া বলেন, ‘১৪ দলের পক্ষ থেকে, আওয়ামী লীগ তাদের যে দাবিগুলো আছে সেগুলো আমার কাছে হস্তান্তর করেছেন। আমি তাদের প্রত্যেকটি দাবি সম্পর্কে ব্যাখ্যা চেয়েছি। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। আমি এ ব্যাখ্যাগুলো নিয়ে আমার দলের কাছে ফেরত যাব এবং দলের সাথে আলোচনা করবো।’
আব্দুল জলিলও একই কথা বলেন। প্রথম বৈঠকের পর তারা জানান যে, আলোচনা আরো চলবে। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে দুটি দাবিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়।
প্রথমত: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানের না থাকা এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে এমএ আজিজের পদত্যাগ। কিন্তু এ দুটি বিষয়ে বিএনপির দিক থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া আসেনি। একদিকে আওয়ামী লীগ রাস্তায় আন্দোলন করতে থাকে এবং অন্যদিকে ক্ষমতাসীন বিএনপি ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখ বিচারপতি কেএম হাসান প্রধান উপদেষ্টার পদ নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ফলে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে বিরোধী রাজনৈতিক জোট নির্বাচন থেকে সরে যায়। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে সে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। ফলে ওয়ান ইলেভেনের সেনা সমর্থিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং প্রায় দুই বছর সেনা-সমর্থিত সরকার দেশ পরিচালনা করে।
সংলাপ ২০১৩: ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। এরপর থেকে সে ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বিএনপির দিক থেকে আন্দোলনের হুমকি দেয়া হয়। ২০১৩ সালের শুরুতে সে আন্দোলন জোরালো রূপ নেয়। বিরোধী দলে থাকা বিএনপির ডাকা হরতাল অবরোধের কারণে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। দেশজুড়ে এ সময় সহিংসতাও হয়। এমন প্রেক্ষাপটে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথমদিকে বাংলাদেশ সফরে আসেন জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। ততদিনে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়েছে। শেখ হাসিনাকে সরকার প্রধান রেখেই নির্বাচনের একটি ফর্মুলা বের করার চেষ্টা করেন জাতিসংঘের প্রতিনিধি। কিন্তু বিএনপি সে বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি।
মি. তারানকো তার সফরের সময় বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেন। এর পাশাপাশি বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সাথেও তিনি বৈঠক করেন। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সাথে নিয়ে বৈঠক করেন। কিন্তু উভয়পক্ষ তাদের দাবিতে অনড় থাকায় শেষ পর্যন্ত কোনো সমাধান ছাড়াই ফিরে যান মি. তারানকো। যাবার আগে সোনারগাঁও হোটেলে এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, উভয়পক্ষ আলোচনা চালিয়ে যেতে রাজী হয়েছে। কিন্তু মি. তারানকোর কথায় পরিষ্কার আভাস মেলে যে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কোনো সমাধানসূত্র বের হয়নি। এর ফলে আসে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত একতরফা নির্বাচন।
সংলাপ ২০১৮: ৭ দফা দাবি নিয়ে গত ১ নভেম্বর গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সংলাপে বসেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। পরের দিন বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের সাথে সংলাপ হয় প্রধানমন্ত্রীর। এর পর অন্যান্য জোট ও দলের সঙ্গে সংলাপ হয়েছে। যদিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছাড়া অন্য সব জোট ও দলের সঙ্গে সংলাপের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতেও কোনো মীমাংসা বেরিয়ে আসেনি। তবে উভয় পক্ষ থেকে আলোচনা আরো চলতে পারে বলে অভিমত দেয়া হয়েছে। আরো আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসবে কিনা, তা এ মুহূর্তে আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হওয়া আবশ্যক। এখন দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়।
লেখক: সাংবাদিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন