আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত, এ শ্লোগান সামনে রেখেই শিশুদের নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তাদের আগামী দিনের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। শিশুদের মাঝেই সুপ্ত থাকে বিভিন্ন প্রতিভা। আর তাদের এই প্রতিভাকে বিকশিত করতে হলে প্রয়োজন শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি কখনো উন্নতির শিখরে আহরণ করতে পারে না। ছিন্নমূল, অধিকারবঞ্চিত শিশুদের আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে তুলতে চাই উপযুক্ত শিক্ষা ও পরিবেশ। শিশুদের ছোটকাল থেকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে না পারলে তারা অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। একটি দেশের সুশিক্ষিত লোকেরাই দেশকে সঠিক পথে পরিচালনা করার পরিকল্পনা বা সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারে। তাই প্রতিটি দেশই তার নাগরিকদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত শিক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে থাকে। আমাদের দেশেও সরকারিভাবে শিক্ষার জন্য বার বার বলা হলেও বাস্তবে তা কাজে আসছে না। তার কারণ দেশ অর্থনৈতিকভাবে এখনও স্বচ্ছল হতে পারেনি। যদিও বলা হয়ে থাকে, দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, এগিয়ে যাচ্ছে দেশের একটি মহল, যাদের আছে অর্থবিত্ত তারাই এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে যে সমস্ত ছিন্নমূল বা ভাসমান শিশু রয়েছে তাদের খবর কে রাখে? তারা লেখাপড়া থাক দূরের কথা, পেট পুরে দু’বেলা খাবার খেতে পারে না। পরতে পারে না কোনো ভালো মানের কাপড়চোপড়। এর একটাই কারণ অভাব-অনটন। দেশের বেশির ভাগ লোক এখনও দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। তাদের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। তারা ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো খাবার ও অন্যান্য মৌলিক অধিকারের সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে না। ঠিক তখনই এসব শিশু জীবন বাঁচানোর তাগিদে সংগ্রামে নেমে বিভিন্ন কাজ-কর্মে জড়িয়ে পড়ে। কুলি, হকার, রিকশাশ্রমিক, ফুল বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, বুনন কর্মী, মাদক বাহক, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ঝঁকিপূর্ণ কাজে তারা নিয়োজিত হয়, যা আমাদের জন্য এবং ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমাদের অযত্ন, অবহেলা, উপযুক্ত পরিবেশ ও শিক্ষা-সুযোগের অভাবে তারা যেন কখনোই ঝরে না যায় সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি শহরে দেখা যায়, ৫-১০ বছরের শিশুরা রাস্তার পাশে সংরক্ষিত ডাস্টবিন বা ময়লার ড্রেন থেকে পচা ময়লাযুক্ত খাবার নিয়ে খাচ্ছে, যেখানে সাধারণের চলাচলের অযোগ্য, সেখানে ক্ষুধার জ্বালায় খাবার খেয়ে যাচ্ছে অসংখ্য ছিন্নমূল শিশু। তারা যে খাবারগুলো ডাস্টবিন বা ড্রেন থেকে তুলে খাচ্ছে সে খাবারগুলোও তাদের মতো কোনো না কোনো মানুষ ফেলেছে। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির রহস্য বুঝা বড় কঠিন। একশ্রেণির মানুষ খাবার খেয়ে ফেলে দিচ্ছে আবার আরেক শ্রেণির মানুষ সে খাবারগুলো ডাস্টবিন বা ড্রেন থেকে তোলে খেয়ে কোনো রকম জীবন বাঁচায়। আমাদের সমাজে এমন শিশুর সংখ্যা স্বাভাবিক শিশুর সংখ্যার চেয়ে কম। নিজেদের চাহিদা মেটাতে অক্ষম, তারা ঘর ছাড়া। আমাদের এই সমাজ তাদের নামের আগে পথকলি, ছিন্নমূল, ভাসমান ও টোকাই নাম দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাদেরও তো একটা পরিচয় আছে, জন্মের সাথে সাথে তো আর তারা ছিন্নমূল, টোকাই হয়ে যায়নি। তাদের ছিন্নমূল ও টোকাই বানানো হয়েছে। ছিন্নমূল হওয়ার পেছনে দায়ী, আমাদের পরিবার, সমাজ রাষ্ট্র। অবাক লাগে এদের দায়িত্ব আমরা কেউই নিতে চাই না। দু’বেলা এক মুঠো ভাতের জন্য তারা চুরি, ডাকাতি, মাদকদ্রব্য সেবন, ভাসমান যৌনকর্মী হিসাবে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। অথচ তাদের তো একটা পরিচয় আছে, স্নেহভরা মায়ের কোল কি তার নিরাপদ আশ্রয়স্থল না? আমরা প্রতিবছর পথশিশু দিবস, কন্যা শিশু দিবস ইত্যাদি পালন করছি। এসব আমরা কাদের জন্য পালন করছি? আমাদের সমাজ আজও কিছুই করতে পারছে না তাদের জন্য। কিছু সরকারি, কিছু বেসরকারি সামাজিক সংস্থা তাদের জন্য এগিয়ে আসলেও সুধী সমাজসহ বিত্তবানদের সহযোগিতা না থাকায় তাদের ভাগ্য আজও পরিবর্তন হচ্ছে না। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এ দেশের দরিদ্র ও অসহায় শিশুরা। আজও তাদের রাস্তার পাশে আইসক্রিম খাওয়ার জন্য ঠিকই আহাজারি করতে হয়, এক মুঠো ভাতের জন্য যুদ্ধ করতে হয়।
দেশের ছিন্নমূল বা ভাসমান শিশুদের উজ্জল ভবিষ্যত গড়ে তুলতে হলে আমাদের সবার এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের এলাকা ভিত্তিক যে সমস্ত ছিন্নমূল বা ভাসমান শিশু রয়েছে তাদেরকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হলে স্ব স্ব এলাকার বিত্তবান লোকদের এগিয়ে আসতে হবে। দেশের শহর, বন্দর, গ্রামসহ যেখানে এসব শিশুরা রয়েছে তাদের সাহায্যর্থে সরকারের পাশাপাশি এলাকার বিত্তবান ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের ভাসমান শিশুদের পুর্নবাসন করা আমার ও আপনার সকলের দায়িত্ব। এসব শিশুকে শিক্ষার বাইরে রেখে দেশকে কখনও সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব না। দেশের প্রতিটি নাগরিক সুশিক্ষায় শিক্ষিত হলে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। দেশের প্রতিটি ভাসমান শিশু শিক্ষিত হলে তাদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন দ্রুত গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের পাশাপাশি দেশের শিল্পপতি, বেসরকারি সাহায্যকারী সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন