জঙ্গিবাদী গ্রুপের সদস্য অথবা সমর্থক সন্দেহে ৮ জন বাংলাদেশী নাগরিককে আটক করেছে সিঙ্গাপুর পুলিশ। এছাড়া আরো ৫ জনকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। ইতোপূর্বে ২৭ বাংলাদেশী নাগরিককে আটক করে গত জানুয়ারী মাসে ২৬ জনকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছিল সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ। সে সময় দেশে ফেরত পাঠানো ২৬ জনের মধ্যে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ১২ জনকে শর্তসাপেক্ষে ছেড়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ পুলিশ। অবশিষ্ট সন্দেহভাজন ১৪ জনের কারোর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগ অদ্যাবধি পাওয়া গেছে কিনা আমাদের জানা নেই। উন্নয়ন অংশীদার, জনশক্তি রফতানী ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এ কথা অনস্বীকার্য যে, সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত হাজার হাজার বাংলাদেশী নাগরিকের বেশীরভাগই ধর্মভীরু এবং এদের একটি অংশ দাড়িটুপিধারী নামাজী মুসলমান। এও অনস্বীকার্য যে, পশ্চিমা সন্ত্রাসবিরোধী সামরিক আগ্রাসনের বিপরীতে বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে কিছু উগ্রপন্থী-জঙ্গিবাদী গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। আল-কায়েদা বা আইএস’র মত জঙ্গি গ্রুপের সৃষ্টি এবং টিকিয়ে রাখার পেছনে পশ্চিমাদের মদদ থাকার অভিযোগও নতুন নয়। আর এসব জঙ্গি গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্টতার সন্দেহভাজন হিসেবে সারাবিশ্বে প্রতিদিন হাজার মুসলমানকে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে সব সময়ই বাংলাদেশে আল-কায়েদা বা আইএস’র কোন কার্যক্রম নেই বলে দাবি করা হচ্ছে। মাঝে মধ্যে যাদের জঙ্গি সন্দেহে আটক করা হচ্ছে তারা কতটা জঙ্গিবাদে সংশ্লিষ্ট তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত নয়।
সিঙ্গাপুরের স্ট্রেইটস টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে গতকাল বাংলাদেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে এবারে জঙ্গি সন্দেহে আটককৃতদের বিরুদ্ধে যে সব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তা, ভয়াবহ। অবশ্য সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে, সিঙ্গাপুরে কোন নাশকতার পরিকল্পনা এদের ছিল না। তবে সিরিয়ায় গিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস’এ যোগ দেয়া এবং বাংলাদেশে এসে সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে নিরাপত্তা বাহিনী এবং সরকারী কর্মকর্তাদের তালিকাভুক্ত সদস্যদের টার্গেটেড কিলিং-এ অংশ নেয়ার যে তথ্য পাওয়া গেছে তা’ সত্যিই উদ্বেগজনক। আটককৃতরা সত্যিই এসব কর্মকা- ও নাশকতা পরিকল্পনার সাথে জড়িত, নাকি ভিন্ন কোন গোষ্ঠীর ফল্স ফ্লাগ অপারেশনের শিকার, তা’ তদন্ত করে খুঁজে বের করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট অভিযোগকারী সংস্থার। গত ২৯ এপ্রিল দেশে ফেরত পাঠানো ৫ সন্দেহভাজনকে ইতিমধ্যেই ঢাকা থেকে আটক করেছে পুলিশ। আমরা আশা করি, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে আটককৃত সন্দেভাজনদের ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।
গণতান্ত্রিক ও মাল্টিকালচারালিজমে বিশ্বাসী সমাজে নানা মত, পথ ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটে থাকে। সেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মতপার্থ্যক্য থাকাই স্বাভাবিক। মতপার্থক্য থেকে আল-কায়েদা বা আইএস’র মত জঙ্গিগোষ্ঠীর সমর্থক ও সক্রিয় সদস্য হওয়া যে কোন সমাজের জন্যই একটি বিপজ্জনক বার্তা বহন করে। ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত পশ্চিমা বিশ্বে যেভাবে নিরাপত্তার অজুহাতে মুসলমান নাগরিকরা যখন তখন হয়রানির শিকার হচ্ছে, একইভাবে নন-ওয়েস্টার্ন, এমনকি কোন কোন মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও একই রকম অভিযোগে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশেও এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। অভিযোগ ও সন্দেহে অনেকে আটক হয়েছে। এবার এসবের প্রমাণ ও মূলোৎপাটন করার পালা। সিঙ্গাপুরে কর্মরত একজন নির্মাণ শ্রমিকের নেতৃত্বে আটজনের কথিত জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসবি (ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশ) গঠন করে বাংলাদেশে সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে কিলিং মিশনের কাহিনীর পেছনে যা-ই থাক, এ ধরনের প্রচারণা বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। সিঙ্গাপুরের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ঐতিহ্য নস্যাৎ করা ছাড়াও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ সংকট বাড়িয়ে দিতে পারে। এ ধরনের ঘটনা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিদেশে অবস্থানরত প্রায় এককোটি বাংলাদেশী শ্রমিকের জন্য এক ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরী করতে পারে। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের পরিবেশ না থাকায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যেও ক্ষোভ বা সরকার বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে। সেই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে কোন নেপথ্য স্বার্থান্বেষী মহল নাশকতার ছক আঁকছে কিনা তা’ এখন তদন্ত করে খুঁজে বের করার বিষয়। নেপথ্য কারণ যা-ই হোক, এ ধরনের অভিযোগ এখন আর অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। দেশের ইমেজ, বহুপাক্ষিক আন্তর্জাতিক স্বার্থ এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থেই এ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের রাজনীতি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন