রেমিট্যান্স আয় তথা বিদেশে অবস্থানকারী প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিলো আনুমানিক ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ মাসে গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা (এখানে ডলারকে বাংলাদেশী মুদ্রায় কনভার্ট করা হয়েছে)। চলতি অর্থ বছরের প্রথম দশ মাসে অর্থাৎ মার্চ মাস পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ৯৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ মাসে গড়ে এসেছে ৯ হাজার ৬ শ’ কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে, গড়ে রেমিট্যান্স কম হয়েছে মাসে ৪শ’ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরে রেমিট্যান্স কম হবে ৪ হাজার ৮ শ’ কোটি টাকা। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি উদ্বেগজনক খবর। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, দুনিয়া জুড়ে যেসব বাংলাদেশী বসবাস করেন তাদের ৬৮ শতাংশই উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদভুক্ত দেশগুলোর বাসিন্দা। এসব দেশ হলো বাহ্্রাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সউদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমীরাত। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ বিপুল বলে যে গর্ব করা হয় তার মূলে রয়েছে দু’টি উৎস। একটি হলো রেমিট্যান্স অর্থাৎ প্রবাসীদের আয়। আরেকটি হলো তৈরি পোশাক পণ্য রফতানী বাবদ আয়। প্রধানত এই দু’টি উৎস থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা। সেই ফরেন রেমিট্যান্স যদি কমে যায় তাহলে উদ্বিগ্ন হওয়ারই কথা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, অর্থনীতির এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে আয় কমে গেল কেন? এ ব্যাপারে সরকারী ও বেসরকারী মহল থেকে ভিন্ন ভিন্ন অভিমত দেওয়া হচ্ছে। সরকারপন্থীরা বলছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দাম দারুণভাবে কমে যাওয়ার ফলে তার অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া হিসেবে রেমিট্যান্সের ওপরেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তেলের মূল্য হ্রাসকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাসের প্রধান কারণ বলে তারা মনে করেন। পক্ষান্তরে বেসরকারী মহল থেকে বলা হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক অতীতে জনশক্তি রফতানীর ক্ষেত্রে ২টি নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছে। একটি হলো, বিদেশে জনশক্তি রফতানীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। অপরটি হলো, বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো কিছু কিছু দেশ থেকে প্রবাসীদের ছাঁটাই করা হয়েছে এবং তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
জনশক্তি রফতানী কোনো কোনো দেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে, আবার কোনো কোনো দেশে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। মালয়েশিয়াতে ৩ লাখ শ্রমিক নেওয়ার কথা ছিলো। এই বিরাট সংখ্যক জনশক্তি ঐ দেশে রফতানীর জন্য দু’টি দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়েছিলো। কিন্তু তীরে এসে তরি ডুবে যায়। মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন ঐ সমঝোতা স্মারকটি আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। এখন বাংলাদেশ থেকে কোনো লোক আমদানী করা হবে না। এই পরিস্থিতি আগামী ৩ বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র মনে করে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের জনশক্তির বড় আমদানীকারক সউদি আরবেও নতুন রিক্রুটমেন্ট প্রায় বন্ধ রয়েছে। এরমধ্যে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সউদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বিল লাদেন কোম্পানির ৭০ হাজার কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশী রয়েছেন। ছাঁটাইকৃত এসব কর্মীকে স্বদেশে পাঠানো হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের কয়েক হাজার কর্মীকেও স্বদেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। প্রতি বছরই বাংলাদেশের বাজেটের আকার বাড়ছে। সেই সাথে আমদানীর পরিমাণও বাড়ছে। আমদানীর পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে আমদানী ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। বলা বাহুল্য, আমদানী ব্যয় মেটাতে হয় বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে। বিদেশী মুদ্রা শুধুমাত্র আমদানী-রফতানীতেই ব্যয় হয় না। বিদেশী মুদ্রার একাংশ টাকায় রূপান্তরিত করে দেশের উন্নয়ন ব্যয়ের একটি অংশও মেটানো হয়। ফরেন রেমিট্যান্স কমে গেলে তার ফিল্টারিং এফেক্ট হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে। আগেই বলা হয়েছে যে, যেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হলো ফরেন রেমিট্যান্স, সেখানে রেমিট্যান্স প্রবাহকে কোনো অবস্থাতেই হ্রাস পেতে দেওয়া যায় না। কনজাম্পশন বা ভোগ অর্থনীতির একটি বড় খাত। এই ভোগ যত বাড়ে মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিও তত বাড়ে। আর মোট ভোগ কমলে জিডিপিও কমে যায়। ফরেন রেমিট্যান্স হ্রাস পাওয়ার এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ভোগ কমে যাবে এবং জিডিপিতে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যারা দারিদ্র্যসীমার সামান্য ওপরে অবস্থান করে তারাই এই ফরেন রেমিট্যান্স বা তাদের আত্মীয়-স্বজনের প্রেরিত অর্থ ভোগ করে। এখন যদি ফরেন রেমিট্যান্স হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকে তাহলে ঐসব ব্যক্তি বা পরিবার পুনরায় দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে, এমন একটি আশঙ্কা থেকেই যায়।
অপর একটি খবরে বলা হয়েছে যে, সাম্প্রতিক অতীতে বিদেশে যে জনশক্তি রফতানী করা হয়েছে তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলো নারী শ্রমিক। বিদেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকের আয় পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে কম। সুতরাং কোনো কোনো দেশে জনশক্তি রফতানী কিছুটা বৃদ্ধি দেখানো হলেও তাদের প্রেরিত অর্থ অর্থাৎ রেমিট্যান্স কিছুটা কমে গেছে। এসব ঘটনার আলোকে সরকারকে যথেষ্ট সতর্ক হতে হবে যাতে করে কোনো অবস্থাতেই অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে আয় অর্থাৎ রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে না যায়। এ জন্য নিত্য নতুন জনশক্তি রফতানীর উৎস খুঁজে বের করতে হবে এবং সেই উৎসকে বহুমুখী করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যারা এখন বিদেশে কাজ করছে তাদের যেন কোনো অবস্থাতেই দেশে ফিরতে না হয়, সেই জন্য সরকারকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন