শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতা ও অর্থসঙ্কট

প্রকাশের সময় : ৬ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

একদিকে অর্থাভাবে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অন্তত ৪৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না অন্যদিকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছে না বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো। সরকারের শীর্ষ মহল থেকে অসন্তোষ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের পক্ষ থেকে বহুবিধ তাগিদ সত্ত্বেও বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসেনি। চলতি অর্থবছরের ১০ মাস (জুলাই-এপ্রিল)  পেরিয়ে এসে এডিপি বাস্তবায়নের হার গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ বলে জানা গেছে। বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে অর্থবছরের শুরুতেই উন্নয়ন বাজেটের আকার দুই দফায় কাটছাঁট করে এক লক্ষ কোটি টাকা থেকে নামিয়ে ৯৩ হাজার কোটি টাকায় পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছিল। এখন ১০ মাস পেরিয়ে এসে দেখা যাচ্ছে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে ৫১.৩৪ ভাগ মাত্র। সরকারের বাজেট বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, একই সময়ে গত অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছিল ৫৬ শতাংশ এবং আগের দুই অর্থবছরে গড়ে ৫৪ শতাংশ। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা নিয়ে গত কয়েক বছরে অনেক আলোচনা ও কথাবার্তা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকেও অসন্তোষ প্রকাশ এবং বাজেট বাস্তবায়নে সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদ দেয়া হয়েছে। এডিপি বাস্তবায়নের সর্বশেষ অবস্থা থেকে বোঝা যায়, সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল অসন্তোষ প্রকাশ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। কাজের সক্ষমতা ও গতি বাড়ানোর কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
গতকাল একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়নের দাবি রাখে এমন অন্তত ৪৪টি প্রকল্প অর্থসঙ্কটের কারণে চলতি অর্থবছরে বাস্তবায়নে অনিশ্চিত অথবা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বলাবাহুল্য, অর্থবছরের আর মাত্র ২ মাস বাকি। এমনিতেই এ সময়ের মধ্যে প্রায় অর্ধেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। অর্থসঙ্কটে অনিশ্চয়তায় পড়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থায়নের সক্ষমতা এই মুহূর্তে সরকারের নেই। বিশেষ গুরুত্বের কারণে সরকারের তাগিদে ৪৪টি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র ৪টিতে অর্থায়ন করতে দাতারা প্রতিশ্রুতি দিলেও ৪০ প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো রয়ে গেছে। অর্থায়ন হলেও বছরের শেষ দুই মাসে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন দূরের কথা কাজ শুরু করা সম্ভব কি না, সে প্রশ্নও উঠতে পারে। শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করে উন্নয়ন বাজেট ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হরিলুটের আয়োজনও সাংবাৎসরিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার কোনো উন্নয়ন প্রকল্প যেন জনগণের পকেট কেটে শ্বেতহস্তি পালনের মতো হয়ে উঠতে দেখা যায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে চার লেনে উন্নীতকরণ অথবা ঢাকায় ফ্লাইওভার প্রকল্প বাস্তবায়নের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ শেষ করতে বারবার সময় বৃদ্ধি, ভুল নকশায় কাজ সম্পাদন এবং নানা অজুহাতে অস্বাভাবিক হারে বাজেট বৃদ্ধির পাশাপাশি দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার অভিযোগও রয়েছে। কোনো কোনো প্রকল্পের কাজের মানহীনতা এবং ধীরগতির কারণে জনভোগান্তি এবং পরোক্ষ অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ও অপচয়সহ প্রকল্পের সামগ্রিক খরচের কয়েক গুণ বেশি। চীনের মতো অর্থনৈতিক পরাশক্তি সম্ভাব্য গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করছে। একইভাবে কুয়েত সরকার পায়রা ও লেবুখালী সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে সম্মত হয়েছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এসব উন্নয়ন প্রকল্পে উন্নয়ন সহযোগীদের বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ আগ্রহ খুবই আশাব্যঞ্জক। তবে এগুলোর বাস্তবায়ন যথাযথ সক্ষমতা ও উপযুক্ত কার্যব্যবস্থার ওপর নির্ভর করবে।
উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে একদিকে জনপ্রত্যাশা, সামাজিক-অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রশ্ন জড়িত থাকে। সেই সাথে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি দলের এমপি-মন্ত্রীদের সস্তা জনপ্রিয়তা বা জনতুষ্টিমূলক রাজনৈতিক প্রকল্পের হিড়িক দেখা যাচ্ছে। অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ এসব প্রকল্পে অর্থ ও জনবল নিয়োজিত করতে গিয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন শুধু পিছিয়েই যাচ্ছে না, কোনো কোনো প্রকল্পের টাকা দাতাদের ফেরত দিতেও বাধ্য হচ্ছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা। চলতি অর্থবছরে পদ্মা সেতু, ঢাকা মাস ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মেঘনা-গোমতি ও দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতুসহ প্রায় একডজন বড় প্রকল্পে দাতাদের বরাদ্দ টাকা ফেরত বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থবছরের শুরুতে ৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও বাস্তবায়নে অক্ষমতার কারণে তা কমিয়ে ৫ হাজার ৯০ কোটিতে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়। অর্থবছরের ৬ মাস পর ডিসেম্বর পর্যন্ত বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে ১ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা ব্যয় দেখানে হয়েছিল। অর্থাৎ অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোতে  হ্রাসকৃত এডিপি বরাদ্দও বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো। একদিকে উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশী দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগী দেশ থেকে প্রাপ্ত ও প্রতিশ্রুত অর্থ প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ করতে ব্যর্থ হওয়া, অন্যদিকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের জন্য অর্থায়নের উৎস অনিশ্চিত থাকার বৈপরীত্য আমাদের উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন চরমভাবে ব্যাহত করছে। অর্থায়নের অগ্রাধিকার নির্ধারণ, সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন, কাজের কাক্সিক্ষত মান নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই ব্যর্থতা ও সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার এসব লুপহোল বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করেই লক্ষ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট গ্রহণের পর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে লেজেগোবুরে অবস্থা হতাশাজনক। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়ার এই ধারা জিইয়ে রেখে মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ করা অসম্ভব। 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন