টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের নতুন চ্যালেঞ্জ এখন আমাদের সামনে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সফলভাবে সহস্রব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) পূরণে সক্ষম হয়েছে। শুধু তাই নয়, এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে গণ্য হয়েছে। এমডিজির সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এসডিজি বাস্তবায়ন এখন আমাদের সামনে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো, এমডিজির চেয়ে এসডিজি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। অনেক চ্যালেঞ্জ থাকলেও বাংলাদেশের জন্য এসডিজি বাস্তবায়নে অনেক সম্ভাবনা বা সুযোগও রয়েছে। কারণ, আমাদের রয়েছে মূল্যবান মানবসম্পদ। মানবসম্পদ যে কোনো দেশেরই শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আর মানবসম্পদের মধ্যে সবচেয়ে কর্মঠ, সৃজনশীল, সক্রিয় এবং মূল্যবান অংশই হলো যুবসম্পদ। বাংলাদেশ এখন মানবসম্পদের শ্রেষ্ঠ এই অংশের সোনালি সময় পার করছে। কারণ আমাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩২ ভাগই এখন যুব, যারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের প্রধান পুঁজি হিসেবে গণ্য হতে পারে। এটা এখন আমাদের ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’। আমাদের সামনে এখন এসডিজি বাস্তবায়নে এই যুবসম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর সূবর্ণ সুযোগ দেখা দিয়েছে। তাই এই যুবসম্পদের মতো মানবসম্পদকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সম্পদে পরিণত করতে পারার ওপর নির্ভর করছে আমাদের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন। সারা বিশ্বেই উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়নে যুবরাই প্রধান ও মূল্যবান অংশীজন হিসেবে আজ স্বীকৃত। শুধু টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়ন নয়, যে কোনো উন্নয়ন ও কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জাতিসংঘসহ প্রতিটি উন্নত রাষ্ট্র, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, নীতি নির্ধারক এবং সমাজ বিজ্ঞানীদের কাছে তাই ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র তথা নতুন পৃথিবীর বিনির্মাণে যুবদের সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হিসেবেই এখন বিবেচনায় নেয়া হয়। তাই এসডিজির লক্ষ্য পূরণে যুব সমাজই হলো আমাদের প্রাণশক্তি।
এমডিজির লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ অনুসরণীয় সাফল্য দেখিয়েছে। এজন্য বাংলাদেশকে বলা হয়, এমডিজির ‘রোল মডেল’। ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল’ (এমডিজি) বা সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সময় শেষ হয়েছে ২০১৫ সালে। এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা ছিল আটটি। ১. চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্মূল করা, ২. সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন, ৩. জেন্ডার সমতা অর্জন এবং নারীর ক্ষমতায়ন, ৪. শিশু মৃত্যুহার হার কমানো, ৫. মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, ৬. এইচআইভি-এইডস, ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য রোগব্যাধি দমন, ৭. পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ এবং ৮. সার্বিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা। এমডিজির সাফল্যের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ এখন এসডিজি বাস্তবায়ন করছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা হলো আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত একগুচ্ছ ভবিষ্যৎ লক্ষ্যমাত্রা। জাতিসংঘ কর্তৃক এ লক্ষ্যমাত্রা প্রণয়ন করা হয়েছে। এসডিজির মেয়াদ ২০১৬ থেকে ২০৩০ সাল। এতে মোট ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা ও ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট টার্গেট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রাসমূহে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ১৯৩টি দেশ একমত হয়েছে।
এসডিজির ১৬৯টি টার্গেটের মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ টার্গেটের সঙ্গে যুবদের গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এসডিজির লক্ষ্যেগুলোর মধ্যে সরাসরি যুবদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে যুবরাই অন্যতম অংশীজন (স্টেকহোল্ডার) যেমন- দারিদ্র্য বিমোচন, জেন্ডার সমতা, কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি, মানসম্মত শিক্ষা এবং জলবায়ু বিষয়ে পদক্ষেপ। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নে যুব সমাজের অংশীজন হিসেবে ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যুবরাই প্রধান চালিকাশক্তি, তারাই প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা রাখে। কিন্তু যুবদের বেকারত্ব নিরসন বা সম্মানজনক কর্মের ব্যবস্থা সারা বিশ্বের জন্যই এসডিজি বাস্তবায়নের প্রধান চ্যালেঞ্জ। বৈশ্বিকভাবে এখন যুব বেকারত্বের হার শতকরা ১৩ দশমিক এক (আইএলও, ২০১৫)। এই হিসাব ধরলে সারা বিশ্বে পুরোপুরি কর্মহীন যুবক ও যুব মহিলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১ মিলিয়ন। প্রায় প্রতি তিন জনে একজন যুবক বা যুব মহিলার দৈনিক আয় মাত্র ৩ ডলারের কম। এদের সংখ্যাও প্রায় ১৫৬ মিলিয়ন। অর্থাৎ গড়পরতা হিসেবে যুব জনগোষ্ঠির শতকরা ৪০.৬ ভাগ এখনও হয় বেকার না হয় কাজ করলেও দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করছে। তাই যুবদের বেকারত্ব নিরসন বা সম্মানজনক কর্মের ব্যবস্থা সারা বিশ্বের জন্যই এসডিজি বাস্তবায়নের বড় চ্যালেঞ্জ।
সা¤প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশ তিন ধাপ এগিয়েছে। ১৮৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৯ যা আগে ছিল ১৪২ তম। তবে শ্রীলঙ্কা, ভারত, ভুটান, মালদ্বীপ আমাদের চেয়ে এগিয়ে। আবার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যুব জনগোষ্ঠির বাস হলেও বৈশ্বিক যুব উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের অবস্থান খুব ভালো নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক যুবগোষ্ঠি এখন এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলেই। শতকরা ৬০ ভাগ যুব জনসংখ্যার বাস এ অঞ্চলে (১৫-২৪), যা সংখ্যায় প্রায় ৭০০ মিলিয়ন। এটা এ অঞ্চলের বিশাল সম্পদ। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের মধ্যে এ অঞ্চলে যুব জনগোষ্ঠির দ্বিতীয় বৃহত্তম অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়। শতকরা ২৬ ভাগ যুব জনগোষ্ঠির বাস দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে। কিন্তু এসব দেশের যুব উন্নয়নের অগ্রগতির হার অত্যন্ত ধীর, গড়ে তিন শতাংশের কম। বৈশ্বিক যুব উন্নয়ন ইনডেক্স রিপোর্টে (ওয়াইডিআই, ২০১৬) সার্বিকভাবে শ্রীলঙ্কা ওয়াইডিআই স্কোর (২০১০-২০১৫) শতকরা ১২ ভাগ অগ্রগতি হয়েছে। এরপর রয়েছে ভারত, শতকরা ১১ ভাগ বেড়েছে। কিন্তু এই সময়ে বাংলাদেশের অগ্রগতির হার শূন্য। আবার বৈশ্বিকভাবে শ্রীলঙ্কার ওয়াইডিআই এ অবস্থান ৩১, ভারত ১৩৩ এবং বাংলাদেশ ১৪৬তম। অথচ এ অঞ্চলের ৪৫ মিলিয়ন যুবকের আয় দৈনিক প্রায় দুই ডলারেরও কম। অর্থাৎ প্রায় ৮৫ মিলিয়ন যুব এ অঞ্চলে অতি দারিদ্র্যের শিকার। এদের অনেকেই ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশায় বিপথে পা বাড়িয়ে সামাজিক শৃঙ্খলা বিরোধী কাজ যেমন- সন্ত্রাস ও মাদক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
এসডিজির লক্ষ্যে উৎপাদনশীল ও উপযুক্ত কাজের সুবিধা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। টেকসই উন্নয়নে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এটা অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। যুবদের বেকারত্ব নিরসন বা সম্মানজনক কাজের ব্যবস্থা সারা বিশ্বের জন্যই এসডিজি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্বের বেকার যুব গোষ্ঠির শতকরা ৯০ ভাগই প্রায় দেশে বাস করে। এই চ্যালেঞ্জ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরও ব্যাপক ও কঠিন। অথচ এসডিজি বাস্তবায়নে এই যুবগোষ্ঠির জন্য যথোপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশই যুব। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ নতুন যুবশ্রমিক শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে।
আশার কথা যে, এমডিজির সফলতার ধারাবাহিকতা নিয়ে বাংলাদেশ এসডিজি বাস্তবায়নে সঠিক পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। সরকারের ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এসডিজির লক্ষ্যসমূহ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইতোমধ্যেই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রাণালয়ও নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে এবং তা বাস্তবায়ন করছে। তবে এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য অর্থায়ন বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জও বটে। কারণ এমডিজির চেয়ে এক্ষেত্রে অর্থের পরিমাণ প্রয়োজন হবে কয়েকগুণ, যা আমাদের মতো দেশের একার পক্ষে যোগান দেয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রায় ৫০ মিলিয়ন যুবশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এসডিজির লক্ষ্য পূরণ করতে যুব উন্নয়ন খাতে প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। তাছাড়া আমাদের এই যুবশক্তি শুধু আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের জন্যই কাজে লাগবে, তা নয়। বরং এসডিজি বাস্তবায়নে যেসব দেশে অভিবাসী দক্ষ শ্রমিক প্রয়োজন তারা আমাদের যুব সম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক খাতে বিনিয়োগ করে নিজ নিজ দেশের এসডিজি বাস্তবায়ন সহজেই করতে পারবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন