শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সরকারী সম্পত্তি অপদখলমুক্ত করা দরকার

প্রকাশের সময় : ৭ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

দেশের প্রায় সব নদ-নদী, রেলওয়ে, বনবিভাগ, সড়ক বিভাগ, হাওর ও জলাভূমি, খাল, স্থানীয় রাস্তা, ফুটপাত ও জেলা পরিষদের আওতাধীন সরকারী জমিজমাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে হাজার হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ একশ্রেণীর প্রভাবশালী ভূমিদস্যু ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তের বেপরোয়া বেদখলের শিকার হয়েছে। বিগত প্রায় চার দশকে এসব রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি দখল হয়েছে। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আবাসন ও অবকাঠামোখাতে এমনিতেই প্রতিবছর শ’ শ’ হেক্টর কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। ফলে সীমিত পরিমাণ কৃষিজমির উপর অত্যধিক চাপ পড়ায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জমির মূল্য। গ্রাম ও শহরের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন এক চিলতে জমিও যখন অব্যবহৃত বা পতিত থাকছে না, তখন সারাদেশে সরকারী মালিকানাধীন হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি অনেকটা বিনা বাধায় বিনা প্রশ্নেই প্রভাবশালী মহলের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে ও হচ্ছে। রেলওয়ে, বনবিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট স্থানীয় প্রশাসন, মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এসব অপদখলের বিরুদ্ধে কোন ভূমিকাই পালন করছে না। পত্র-পত্রিকায় সরকারী সম্পত্তি দখলবাজির রিপোর্ট প্রকাশের পর মাঝে মধ্যে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে লোক দেখানো উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে দেখা গেলেও এসব অভিযানের সার্বিক যোগফল পর্বতের মূষিক প্রসবের মত।
উজানে ভারতের ফারাক্কা, গজলডোবা ব্যারাজ ও বিভিন্ন বাঁধের মাধ্যমে নির্বিচার পানি প্রত্যাহারের কারণে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ-নদীর বিশাল অংশ নাব্যতা হারিয়েছে। পদ্মা-যমুনা, তিস্তা, গোমতীর শ’ শ’ শাখা নদী শুকিয়ে বিলীন হয়ে গেছে। বিলীন হওয়া অথবা ক্রমহ্রাসমান অবস্থায় টিকে থাকা প্রতিটি নদীরকূল প্রকাশ্য দখলবাজির শিকার হচ্ছে। বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলী থেকে শুরু করে বিভাগ ও জেলা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রতিটি নদীতট স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের বেপরোয়া দখলবাজির শিকার হলেও সরকারের সংশ্লিষ্টরা যেন দেখেও না দেখার ভান করে দায়িত্ব এড়াচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকার সরকারী সম্পত্তি বেহাত হয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কখনো জবাবদিহিতা করতে হয় না। এ কারণে তাদের যোগসাজশে বা স্থানীয় প্রভাবশালীরা ক্ষমতার দাপটে অথবা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করেই সরকারী জমি দখলের মহোৎসব চালিয়ে যাচ্ছে। রাজধানী শহরে এক খ- জমি এখন সোনার হরিণের মত। এখানেও রেলওয়ের শ’ শ’ একর জমি রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা দখল করে আছে। বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদী, খাল, গুলশান-বনানী ও ধানমন্ডি লেকের জমিতে গড়েওঠা অবৈধ স্থাপনা নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও ঢাকার বাইরে প্রতিনিয়ত সরকারী জমির দখলবাজির চিত্র অনেকটাই অপ্রকাশিত রয়ে যাচ্ছে। এসব জমি উদ্ধারের কোন তৎপরতা নেই ।
একটি দেশের আয়তন ও জনসংখ্যা অনুপাতে অন্তত ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন বাস্তু বিশেষজ্ঞরা। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন ও আবাসনের গ্রাসে আমাদের সীমিত পরিমাণ বনভূমি এখন শতকরা ৭-৮ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। কক্সবাজারের সমুদ্রোপকূল ও দ্বীপ থেকে শুরু করে কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত ও সংরক্ষিত বনভূমি এবং গাজীপুরের ভাওয়ালের গড় ও জাতীয় উদ্যান পর্যন্ত সর্বত্রই দখলবাজরা সক্রিয় রয়েছে। হাজার হাজার হেক্টর বনভূমি তাদের দখলে গিয়ে বন ও পরিবেশ বিনাশী অবকাঠামো গড়ে উঠছে। বন্দর নগরী চট্টগ্রামসহ দেশের পার্বত্য এলাকায় চলছে পাহাড় কাটা ও পাহাড়িভূমি বেদখলের মচ্ছব। আগেই বলা হয়েছে, দেশের নদ-নদীগুলো উজানের বাঁধ ও পানি প্রত্যাহার, শিল্পদূষণ ও দখলবাজির শিকার হয়ে অস্তিত্বের সংকটে পড়তে শুরু করেছে। একদিকে শহর ও জনপদে রেলওয়ে, সড়ক বিভাগ, স্থানীয় সরকারের আওতাভুক্ত জমিজমা দখল হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে দখলবাজরা নদী, বনভূমি, খাল-বিল ও পাহাড়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে দেশকে একটি অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রকাশিত এক সূত্রে জানা যায়, শুধুমাত্র বাংলাদেশ রেলওয়ের সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমি বেদখলে রয়েছে। এমনকি কোথায় কোন সংস্থার কি পরিমাণ জমি বেদখলে রয়েছে তার সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যানও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হাতে নেই। এ থেকে সরকারী সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা ও অনাগ্রহের চিত্রই বেরিয়ে আসে। ইতিমধ্যে রাজধানী ঢাকা নগরী বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। সারা বাংলাদেশ পরিবেশগত ভারসাম্য হারিয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ার আগেই সব সরকারী ও পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমি থেকে অবৈধ দখলবাজদের হটানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। দখলবাজরা যত প্রভাবশালীই হোক, তাদের সাথে কোন আপস বার ছাড় দেয়া চলবে না। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জিরো টলারেন্স গ্রহণ করতে হবে। রেলওয়ে, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বনবিভাগ এবং সকল স্থানীয় প্রশাসনের বেদখল সম্পত্তি জরিপ করে পুনরুদ্ধারের সাথে সাথে তা’ যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। খুব প্রয়োজন হলে ক্ষেত্র বিশেষে জমি লজি প্রদান করা যেতে পারে, যাতে সরকার অর্থ পাবে। কোনো বিবেচনাতেই সরকারী সম্পত্তি অনিরাপদ ও বেদখলে রাখা যাবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন