শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আল্লামা শাববীর আহমদ উসমানী (রহ.) এবং তার বিখ্যাত তাফসির

কে. এস সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

আল্লামা শাববীর আহমদ উসমানী (রহ.) ছিলেন উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী উলামায়ে ইসলাম এবং ব্রিটিশ বিরোধী রেশমী, খেলাফত ইত্যাদি আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা শায়খুল হিন্দ হজরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রহ.)র প্রিয় শাগরিদ এবং তারই অনূদিত কোরআনের ভাষ্যকার, যা ‘তফসীরে উসমানী’ নামে বিখ্যাত। ‘সিহাহ সিত্তার’ দ্বিতীয় বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ ‘মুসলিম শরীফে’র আরবী ভাষায় রচিত সুবিখ্যাত ‘শরাহ’ বা ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘ফাতহুল মুলহিম’ নামক গ্রন্থ-সমগ্র আরব বিশ্বে দারুন আলোড়নের সৃষ্টি করে।
বিশ^বিখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসার কৃতি ছাত্র ও খ্যাতিমান শিক্ষক আল্লামা শাববীর আহমদ উসমানী (রহ.) ‘শায়খুল ইসলাম’ উপাধীতে ভ‚ষিত ছিলেন। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের অসংখ্য বিখ্যাত উলামায়ে কেরাম দারুল উলুম দেওবন্দে তার নিকট শিক্ষালাভ করেন, যারা স্ব স্ব স্থানে সুখ্যাতির অধিকারী ছিলেন, তাদের কেউ কেউ হয়তো এখনো বেঁচে থাকতে পারেন।
১৯৪৬ সালে অবিভক্ত ভারতের কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ‘জমিয়াতে উলামায়ে ইসলামে’র প্রথম সভাপতি, স্বাধীনতা সংগ্রামে উলামা সমাজের রাজনীতিতে আল্লামা শাববীর আহমদ উসমানী (রহ.)র উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথা বাদ দিয়ে আমরা তাঁর কেবল ইসলামী ইলমী অবদানের ওপর কিঞ্চিত আলোকপাত করতে চাই। বিশেষত কোরআনের তফসির ও হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা উসমানী (রহ.) যে আসমানী অবদান রেখেছেন, ইসলামের আধুনিককালের ইতিহাসে তা এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে।
শায়খুল ইসলাম আল্লামা উসমানী (রহ.) হিজরী ১৩০৫ মোতাবেক ১৮৮৬ সালে এক সম্ভ্রান্ত শায়খ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন স্কুল ইন্সপেক্টর। দেওবন্দের প্রধান মুফতী মওলানা আজীজুর রহমান উসমানী ও তার প্রধান অধ্যক্ষ (ছদরে মুহতামিম) মওলানা হাবীবুর রহমান উসমানী ছিলেন তার বড় ভাই। তিনি যাবতীয় শিক্ষা দেওবন্দেই লাভ করেন। শায়খুল হিন্দ ছিলেন তার বিশিষ্ট ওস্তাদগণের মধ্যে প্রধান। তিনি দিল্লী ফতাহপুর মাদরাসায় এবং ডাবিল ও দেওবন্দে ৪৫ বছরকাল প্রধান অধ্যক্ষ ছিলেন। একজন মোহাদ্দেস, মোফাসসির, সুবক্তা, লেখক এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে সর্বত্র তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল।
আল্লামা শাববীর আহমদ উসমানী (রহ.) ইসলামের নানা বিষয়ের উপর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে কোরআনের তর্জমা ও তফসির এবং মুসলিম শরীফের আরবী ‘শরাহ ফাতহুল মুলহিম’ (৪ খণ্ডে প্রকাশিত) যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। ফাতহুল মুলহিমের বিরাট ভ‚মিকা বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমৃদ্ধ। হাদীস অধ্যয়নকারীদের জন্য এর ভ‚মিকা খুবই প্রয়োজনীয়। আল্লামা জাহেদুল কাওসারী এ ভূমিকার ভ‚য়সী প্রশংসা করেছেন। আরব বিশে^র উলামায়ে কেরাম এটি পাঠ করে বিস্মিত হয়েছেন বলে জানা যায়। হাদীস শাস্ত্রে আল্লামা উসমানী রচিত আরেকটি গ্রন্থ হচ্ছে, ‘লাতায়িফুল হাদীস’। তার রসুলুল্লাহ (স.) এর মোজেজা সংক্রান্ত একটি আরবী গ্রন্থ রয়েছে বলেও জানা যায়।
শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান ও শায়খুল ইসলাম আল্লামা উসমানীকৃত তর্জমা ও তফসিরের সংক্ষিপ্ত নাম আলকোরআনুল করীম ১৯৮৯ সালে ‘বাদশাহ ফাহাদ কোরআন শরীফ প্রিন্টিং কমপ্লেক্স’ মদীনা মোনাওরায় সউদী আরবের আওকাফ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়। শুরুতে মরহুম বাদশাহ ফাহাদের পৃষ্ঠাব্যাপী আরবীতে একটি ভূমিকা রয়েছে। আল কোরআনুল করীমের শেষ দিকে মোদাসসিরের ৮ পৃষ্ঠাব্যাপী উর্দূতে এক বিশাল ‘মোকাদ্দমা’ ভ‚মিকা রয়েছে। এতে শায়খুল হিন্দ বলেন, ‘আমি গুনাহগার বান্দা মাহমুদ ইবনে মওলভী জুলফিকার আলী দেওবন্দ, জলা সাহারানপুরের অধিবাসী (আল্লাহতালা তাকে এবং তার- পিতামাতাকে মাফ করুন) নিবেদন করছে যে, কোনো কোনো বন্ধুত্ব সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ বান্দার নিকট আবেদন করেন যে, কোরআনের সহজ ও অর্থবোধক উর্দূ ভাষায় মানুষের সময়োপযোগী তর্জমা করা দরকার, যাতে পাঠকদের অধিক ফায়েদা হয়।’ তার এ সুদীর্ঘ তালিকায় কোরআনের অনুবাদ সংক্রান্ত বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য স্থান পেয়েছে। বাংলা ভাষায় এ তর্জমা ও তফসীরের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা যায়।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, সউদী আরব হতে এই আল কোরআনুল করীম নতুন আঙ্গিকে বড় সাইজে সুসজ্জিতভাবে প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে আমাদের দেশে এর পুরনো সংস্করণ মাদরাসার আরবী পড়ুয়া ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।
আধুনিক যুগে উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ উলামায়ে-কেরামের মধ্যে যারা কোরআনের তফসির রচনা করেছেন সেগুলো প্রায় সবই উর্দূ ভাষায় এবং অধিকাংশ বাংলায় অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে। এসব তফসিরের মধ্যে কোরআনের সংশ্লিষ্ট বহু আয়াতের আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিফলিত হয়েছে। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলোর মূল্যায়ন করা হয়েছে এবং আয়াত হতে নতুন নতুন নানা বিষয়েরও উদ্ভাবন বা আবিষ্কারের ধারা অব্যাহত আছে। শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাববীর আহমদ উসমানী (রহ.)সহ আরো অনেকের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে যা এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। আমাদের প্রতিপাদ্য তফসিরে উসমানীতে বর্ণিত আল্লাহর অসীম ‘কুদরত’ সংক্রান্ত একটি ঘটনা যা বাংলাদেশসহ আরো কয়েকটি স্থানে দৃশ্যমান। এ অদ্ভুত ঘটনার বিবরণ প্রদান করেছেন আল্লামা উসমানী তাঁর বিখ্যাত তফসিরে। উদাহরণ পেশ করেছেন হাক্কীমুল উম্মত হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর (রহ.) সুপ্রসিদ্ধ তফসির ‘কানুল কোরআন’ হতে। বিষয়টি হচ্ছে দুই নদীর মিলন ক্ষেত্রে পানির স্রোতধারায় পানির রং, রূপ ও স্বাদে বিভিন্নতা সম্পর্কে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার অক্ষমতা এবং আল্লাহর কুদরতের বিস্ময়কর মহিমা-মাহাত্ম্য। এবার দেখা যাক, আল্লাহ তার কুদরতে কামেলার দ্বারা দুই দরিয়াকে মিলিতভাবে প্রবাহিত করে কীরূপে একটির পানি মিষ্ট এবং অপরটির লোনা করেছেন। কোরআনের সূরা: (ফোরকান) আয়াত: ২৫ এ আল্লাহ পাক বলেন, ‘তিনিই দুই দরিয়াকে মিলিতভাবে প্রবাহিত করেছেন, একটি মিষ্ট-সুপেয় এবং অপরটি লোনা। উভয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছেন ব্যবধান’ (আয়াত: ৫৩)। আয়াতটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তফসিরে উসমানীতে যা বলা হয়েছে তা নিম্নরূপ: ‘বয়ানুল কোরআনে দুইজন বাঙ্গালী আলেমের সাক্ষ্য উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, আরাকান হতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত দরিয়ার অবস্থা এই যে, উহার দুই দিকে একবারে আলাদা আলাদা ধরনের দুইটি দরিয়া দৃষ্টিগোচর হয়। একটির পানি স্বচ্ছ, সাদা, অপরটির কালো, কালোটিতে সমুদ্রের ন্যায় তুফানি উত্তাল তরঙ্গ ও ঢেউ খেলে এবং সাদাটি একেবারে স্থিত, শান্ত। সাদাটিতে নৌকা চলাচল করে এবং উভয়ের দুই দিকের মাঝখানে একটি খালের ন্যায় সরাসরি চলে গিয়েছে যা উভয়েরই মিলন কেন্দ্র। লোকেরা বলে থাকে সাদা পানি মিষ্ট এবং কালোপানি তিক্ত-লোনা।’
বয়ানুল কোরআনের এ বর্ণনা উল্লেখ করার পর আল্লামা উসমানী (রহ.) তার নিজের কোনো বরিশালী ছাত্রের বরাতে বলেন, ‘আমাকে বরিশালের কোনো ছাত্র বলেছে, বরিশাল জেলায় এমন দুটি নদী আছে, যা একই দরিয়া হতে নির্গত একটির পানি একেবারে লোনা তিক্ত এবং অপরটির পানি খুবই মিষ্ট ও সুপেয়।’ অনুরূপ আরেকটি উদাহরণ পেশ করেছেন আল্লামা উসমানী (রহ.)। তিনি উল্লেখ করেন, এই লেখক আল্লামা উসমানী (রহ.) বর্তমানে যেস্থানে অবস্থান করছেন, তা সমন্দর (সাগর) হতে প্রায় দশ বারো মাইল দূরে অবস্থিত (সাওয়াত জেলার ডাবিল)। এখনকার নদীগুলোতে সর্বদা জোয়ার ভাটা হতে থাকে। বিশ্বস্ত বহু লোকের বর্ণনানুযায়ী, জোয়ারের সময়ে যখন সাগরের পানি প্রবেশ করে তখন লোনা পানি বহু বেগে ওপরে চলে আসে, কিন্তু কখনো পানি মিশ্রিত হয় না, ওপরে ধারক বিদ্যমান থাকে এবং নিচে মিষ্ট পানি জোয়ারের সময় ওপর হতে ধার (লোনা) সরে যায় এবং মিষ্ট পানি পূর্ববৎ অক্ষুণ্ন থেকে যায়। (ওয়াল্লাহু আলামু) আয়াত: ৫৩
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের আরো একটি বাস্তব ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। স›দ্বীপ ও চট্টগ্রামের মাঝখানে সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রবাহিত, যা উভয় দিকে প্রলম্বিত, একটি চ্যানেল ‘ফেনী চ্যানেল’ নামে খ্যাত। উভয় ভূ-খণ্ডের মধ্যে প্রস্থে দূরত্ব বিভিন্ন স্থানে কমবেশি আছে। দক্ষিণ প্রান্তে সর্বনিম্ন ১৪/১৫ মাইলের কম হবে না। লোকপারাপারের প্রধান মাধ্যম দেশীয় নৌকা ‘সাম্পান’। কুমিরা ঘাটের দিক থেকে দৈনিক লঞ্চ সার্ভিস চালু আছে। মাঝিমাল্লা ও এ সাগর এলাকার পাড়িদাতাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এই যে, উভয় ভূ-খণ্ডকে পার্থক্যকারী সাগর এলাকার ‘ধার’ নামে সাতটি স্তর আছে এবং প্রতিটি ধার নিজস্ব ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে প্রবাহমান। কথিত ধারগুলোর পানির রং-রূপ-বর্ণ একটার সাথে আরেকটা আলাদা সাগরের দক্ষ মাঝিমাল্লারা প্রবল জোয়ারের সময়েও এ বিভিন্নতা লক্ষ্য করার দাবি করে থাকেন। তবে শীতকালে সাগর যখন শান্ত, স্বচ্ছ থাকে, অন্য সময়ের ন্যায় উত্তাল তরঙ্গ থাকে না, তখন সাগর অতিক্রমকারীর ধারগুলো প্রত্যক্ষ করতে পারে। দুই প্রান্তসীমার ক‚লবর্তী ধারগুলো মাঝিমাল্লাদের ভাষায় ‘পাগলা ধার’ বলে পরিচিত। কথিত এ উত্তাল পাগলাধারগুলোতে অধিকাংশ সময়ে নৌদুর্ঘটনা ঘটে, যার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে।
এ শ্রেণির প্রাকৃতিক ঘটনা সম্বলিত কোরআনী আয়াতের চমৎকার ব্যাখ্যা তফসিরে উসমানীতে নানা স্থানে লক্ষ করা যায়। বিশেষত ‘মারাজাল বাহরাইনে’ এর তফসির করতে গিয়ে আল্লামা উসমান বাংলাদেশ ও ডাবিনের বিভিন্ন দরিয়ার যে দৃষ্টান্তগুলো উপস্থাপন করেছেন, তাতে আল্লাহর অসীম কুদরতের কথা প্রকৃষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, কুদরতে এলাহীর অঙ্গীকারকারীদের জন্য এতে চিন্তার বহু খোরাক রয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন