গত বছর ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আগে নির্বাচিত দুই মেয়র উত্তরের আনিসুল হক ও দক্ষিণের সাঈদ খোকন রাজধানীবাসীকে অসংখ্য উন্নয়ন কর্মসূচির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাদের মেয়াদের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এই এক বছরে তারা প্রতিশ্রুতির কতটুকু পূরণ করতে পেরেছেন, তা নিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। নগরবিদরা মেয়রদ্বয়ের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলছেন, উত্তরের মেয়র কিছু কাজ করলেও, দক্ষিণের মেয়রের সাফল্য একেবারেই মøান। দুই সিটি করপোরেশনের অন্যতম প্রধান সমস্যা যানজট, পানিজট, বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং দিন দিন এসব সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। উত্তরের মেয়রের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে, একুশ’ হাজার বিলবোর্ড সরানো, ই-টেন্ডার ব্যবস্থা, সাতরাস্তা থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত সড়ক দখলমুক্ত করা, গাবতলী-আমিনবাজার, মোহাম্মদপুর, আবদুল্লাহপুরসহ রাজধানীর দশটি স্থান অবৈধ পার্কিংমুক্ত করা এবং বিভিন্ন স্থানে বনায়ন করার উদ্যোগ। দক্ষিণের মেয়র রাস্তা থেকে কিছু অবৈধ বিলবোর্ড সরিয়েছেন, কিছু রাস্তায় এলইডি বাতি লাগিয়েছেন এবং রাস্তায় ছোট আকারের আবর্জনা ফেলার ঝুলন্ত কিছু বিন বা বাস্কেট লাগিয়েছেন। এছাড়া তার প্রতিশ্রুত বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি আলোর মুখ দেখেনি। এ ব্যাপারে তার বক্তব্য হচ্ছে, এক বছরই তো মাত্র গেল। আরও তিন বছর হাতে আছে। অন্যদিকে উত্তরের মেয়র তার কাজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, অর্জন হয়তো অনেক নেই। তবে অল্প হলেও আছে। কথা দিচ্ছি, আগামী তিন বছর পর কোনো খুঁত খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আমাদের দেশে নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা অজস্র উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেন। যেন তাদের নির্বাচিত করলে নিজ নিজ এলাকা বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় এলাকায় পরিণত হবে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রদ্বয়ও এমন প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়িয়েছিলেন। দক্ষিণের মেয়রতো ইশতেহার ঘোষণার সময় বলেই দিয়েছিলেন, যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, সেগুলো জীবনের বিনিময়ে হলেও বাস্তবায়ন করব। নগরবাসীও তাদের কল্পনাতীত দুই মেয়রের প্রতিশ্রুতির কথা শুনেছে। তারা এটাই মনে করেছে, দুই মেয়র উচ্চশিক্ষিত এবং ভাল মানুষ। নিশ্চয়ই তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবেন। চার বছর মেয়াদের এক বছর চলে যাওয়ার পর নগরবাসী মেয়রদ্বয়ের প্রতিশ্রুত কর্মসূচির হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছে, কিছু সহজসাধ্য কাজ ছাড়া মূল সমস্যার দিকে মেয়রদ্বয় নজর দিতে পারেনি। উত্তরের মেয়র সাহস করে কিছু কাজ করেছেন, তবে আংশিক এ কাজ করে কৃতিত্ব নেয়ার মতো কিছু ঘটেনি বলে নগরবাসী মনে করে। নগরবাসী তাকে দায়িত্বই দিয়েছে এ কাজ করতে। উল্টো নগরবাসী প্রশ্ন তুলতে পারে, তার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় কি যানজট, পানিজট, মশার উপদ্রব, অসময়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, যত্রতত্র বর্জ্য ফেলা, ফুটপাত দখলমুক্ত করার মতো কমন সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব হয়েছে? তার প্রতিশ্রুত বেদখল হওয়া পার্ক ও মাঠ উদ্ধার, তরুণদের জন্য আধুনিক স্বাস্থ্য ও ক্রীড়াকেন্দ্র নির্মাণ করা, নগর স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বল্প-নিম্ন আয় ও বস্তিবাসী নাগরিকদের জন্য সুলভে চিকিৎসা দেয়া, স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যের বাসস্থান নির্মাণ করা, ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরির কর্মসূচি কি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে? বাস্তবতা হচ্ছে, উত্তরের নগরবাসী মেয়রের প্রতিশ্রুত এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দেখেনি। তারা শুধু দেখেছে টেলিভিশন ক্যামেরার মাধ্যমে মহাসাড়ম্বরে কিছু অপদখলীয় এলাকার উচ্ছেদদৃশ্য। এটা অনেকটা ক্যামেরা ট্রায়ালের মতোই নগরবাসীর কাছে প্রতীয়মাণ হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণের মেয়রের ব্যর্থতা তো চোখে পড়ার মতো। বলতে গেলে তার প্রতিশ্রুত কোনো কিছুরই অগ্রগতি নেই। ফুটপাত, পার্ক দখলমুক্ত করা নিয়ে এক ধরনের ইঁদুর-বিড়াল খেলা হয়েছে। সকালে উচ্ছেদ তো বিকেলে দখল। শেষ পর্যন্ত দখলদারদেরই বিজয়। এখন মেয়র অজুহাত দিচ্ছেন, পুলিশের সহযোগিতা ছাড়া ফুটপাত ও রাস্তা পুরোপুরি দখলমুক্ত করা সম্ভব নয়। প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন? তিনি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। অথচ তার এলাকার বাসিন্দারা দেখছেন, তিনি কেবল যুদ্ধই ঘোষণা করেছিলেন, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। তিনি বলেছিলেন, যানজট নিরসন তার অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার। দেখা যাচ্ছে, বিগত এক বছরে পুরান ঢাকায় যানজট আরও বেড়েছে। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি অসময়েই চলছে। তার প্রতিশ্রুত কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল নির্মাণ, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সহজলভ্যতা, মশার উপদ্রব কমানো, পানিবদ্ধতা, কমানো, বৈধ ও নতুন কাঁচাবাজার নির্মাণ, মেটারনিটি সেন্টার নির্মাণ, লেক উন্নয়ন, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, সুপেয় পানির নিশ্চয়তা ইত্যাদির যে কিঞ্চিত সমাধানও হয়নি, তা তার এলাকার বাসিন্দারা ভাল করেই জানে। ঢাকার প্রাণ হিসেবে খ্যাত বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত ও নিরাপদ রাখার অঙ্গীকারও তিনি করেছিলেন। বাস্তবতা হচ্ছে, বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্ত ও নিরাপদ রাখা দূরে থাক, উল্টো সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ফেলে আরও দূষিত করা হচ্ছে।
‘প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার জন্য’, আমাদের দেশে এ ধরনের একটি নেতিবাচক কথা প্রচলিত রয়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের দুই মেয়রের এক বছর মেয়াদ শেষে এসে দেখা যাচ্ছে, তাদের প্রতিশ্রুতি এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেন এ কথাই প্রযোজ্য। রাজধানীর চিরকালের কমন ও মৌলিক সমস্যাগুলো আজও বিদ্যমান এবং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সার্বিক বিচারে দুই মেয়রের এক বছর সময়কালে সাফল্য নগন্যই বলতে হয়। অথচ নগরবাসী চিরকালের এসব সমস্যা সমাধানে দুই মেয়র সফল হবেন, এই আশায় বুক বেঁধেছিলেন। তাদের সে আশায় যে গুঁড়ে বালি পড়েছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে আশা ভঙ্গের বেদনা নিয়ে নগরবাসী নিশ্চয়ই আবারও আশায় বুক বাঁধবে এবং মেয়রদ্বয়ের দ্বারাই সে আশা পূরণ সম্ভব হবে বলে বিশ্বাস স্থাপন করবে। কারণ তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখভালের দায়িত্ব মেয়রদ্বয়ের উপরই তারা ন্যাস্ত করেছে। আমরাও চাই, মেয়রদ্বয় নগরবাসীর জীবনযাপন সহজ করতে তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আরও সক্রিয় হবেন। তাদের প্রতিশ্রুতি যে শুধু কথার কথা বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য করা হয়নি, তা প্রমাণে সচেষ্ট হবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন