শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বিপর্যয় মানুষের পাপের কারণে

মুহাম্মদ আবদুল হামিদ | প্রকাশের সময় : ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

পাপ-পূণ্য মিলিয়েই মানুষ। জগতে মানুষ কবিরা-ছগিরা, জাহিরা-বাতিনা, জানা-অজানা বেহিসাব পাপ করে। কেউ পাপ করে ইচ্ছকৃতভাবে আর কেউ অনিচ্ছায়। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের গুণ হচ্ছে, যখনই তাদের দ্বারা কোনো পাপকাজ সংগঠিত হয়ে যায়, সাথে সাথে তারা আল্লাহর কাছে তাওবা করে নেন। কিন্তু যখন মানুষ পাপকাজ করতে করতে পাপে অভ্যস্ত হয়ে যায়, পাপকাজ থেকে ফিরে আসে না, তখনই আল্লাহ তা’লা রাগান্বিত হন। তখনই মানুষের উপর নেমে আসে বিভিন্ন রকমের বালা-মুসিবত, আযাব আর গজব।
ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, সুনামি, মরুঝড়, মাহমারী, বজ্রপাত, নদী ভাঙ্গনসহ আরো কতো দুর্যোগ দুনিয়ার জমিনে দেখা দেয়। এগুলোকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে অভিহিত করা হয়। একেকটা দুর্যোগ একেকটা জনপদকে বিরানভূমিতে পরিণত করে দেয়। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ায় সুনামিতে শত শত মানুষ মৃত্যু বরণ করেছেন। লাখ লাখ মানুষ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হয়েছে। এর আগে জাপানসহ কয়েকটি দেশে ভয়াববহ টাইফুনের আঘাতে বিস্তীর্ণ জনপদে বিপর্যয় হয়েছে। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ভেসে গেছে ভারতের কেড়ালা রাজ্য। অতিবৃষ্টি, অকাল বন্যা, খড়া, ঝড়-তুফান এখনকার সময়ে কোনো রকম প্রাকৃতিক নিয়ম-নীতি ছাড়া যখন-তখন আছড়ে পড়ে। মানুষ এগুলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে অভিহিত করলেও মূলত এসব বিপর্যয় মানুষের পাপের ফলাফল। কুরআনে আল্লাহ তা’লা বলেছেন, ‘জলে-স্থলে যত দুর্যোগ দেখা দেয় সবই মানুষের পাপের কারণে।’
মানুষের মধ্যে পূণ্যের চেয়ে পাপের মাত্রা বেড়ে গেছে। এ কারণেই দুর্যোগ-বিপর্যয়ও বাড়ছে। মানুষ যত আল্লাহর অবাধ্য হয়, বিপদ ততই ঘনিয়ে আসে। অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ তা’লা বহু জাতি ও জনপদকে ধুলার সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন, সাগরে বিলীন করে দিয়েছেন। এরকম বহু ঘটনা আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে।
হযরত নূহ (আ.) এর কওম যখন আল্লাহর অবাধ্য হয়ে পাপাচারে লিপ্ত হলো, আল্লাহ তা’লা ভীষণ ক্রুব্ধ হয়ে তাদের অভিশাপ দিলেন। বন্ধ করে দিলেন বৃষ্টি বর্ষণ। ফলে তাদের ফসলাদি ও প্রাণিসম্পদ কমে যেতে লাগলো। এতেও যখন তাদের বোধোদয় হলো না। তারা তওবা করলো না। হযরত নূহ (আ.) এর কথায় কর্ণপাত করলো না। তখন তাদের উপর নেমে এলো আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন আযাব। তাদের চুলাসমূহ থেকে পানি উথলে ওঠে প্রবাহিত হতে লাগলো, আকাশ মুষলধারে অবিরাম বৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগলো। চারদিক থেকে অধিবাসীদের বেষ্টন করে ফেললো। নূহ (আ.) এর ছেলে কেনানসহ যারা আল্লাহর অবাধ্যতা করেছিল তাদের কেউই রক্ষা পায়নি। যখন পাপিরা সবাই পানিতে নিমজ্জিত হলো, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো- কুরআনে বর্ণিত হচ্ছে, ‘হে জমীন, তুমি তোমার পানি গিলে নাও, হে আসমান, তুমি বর্ষণ থেকে ক্ষান্ত হও, এক সময় পানি প্রশমিত হলো, আল্লাহর কাজও সম্পন্ন হলো।’ সেদিন যারা হযরত নূহ (আ.) এর কথায় ঈমান এনেছিল এবং পাপকাজ থেকে ফিরে এসেছিল, শুধুমাত্র তারাই এই মহা প্লাবন থেকে রক্ষা পেয়েছিল।অনুরূপভাবে ‘আদ’ জাতিকে আল্লাহ তা’লা অফুরন্ত নেয়ামত দান করেছিলেন। নেয়ামত পেয়ে তারা যখন আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হলো, তখন আল্লাহ তা’লা হুদ (আ.)কে তাদের কাছে নবী হিসেবে প্রেরণ করলেন। কিন্তু তারা হুদ (আ.) এর দাওয়াত অমান্য করলো। এমনকি হুদ (আ.) এর কথায় ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে লাগলো। আল্লাহ তা’লা রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দিলেন। বৃষ্টির জন্য তারা হাহাকার করতে আরম্ভ করলো। একদিন তারা আকাশে একখন্ড কালো মেঘ দেখে আনন্দে উৎসব শুরু করলো। হযরত হুদ (আ.) বললেন, এটা রহমতের মেঘ নয়, বরং তা কঠিন আযাববাহী বায়ু। আর তা-ই হলো। প্রচন্ড ঝড় শুরু হলো। ঝড়ের আঘাতে গাছ-পালা উপড়ে ফেললো, বাড়ি-ঘর বিলীন করে দিলো এবং পশু-পাখিকে উড়িয়ে দূরে নিয়ে গেলো। আল্লাহর গজবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো ‘আদ’ জাতি। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘ভালো করে শুনে রেখো, আদ জাতি তাদের মালিককে অস্বীকার করেছিলো; এও জেনে রেখো, ধ্বংসই ছিলো হুদের জাতি আদ-এর একমাত্র পরিণতি।’ সূরা হুদ- ৬০
হযরত লূত (আ.) এর কওমের লোকেরা যখন পাপচারে লিপ্ত হলো। সমকামিতার মতো ঘৃণ্য ও জঘন্য পাপাচার যখন তাদের পেশায় পরিণত হলো। এমনকি তারা লূত (আ.) এর সাথে চরম অসভ্য আচরণ করলো। তখন তাদের উপর নেমে এলো প্রচন্ড গজব। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘অতঃপর যখন আমার আযাবের নির্ধারিত হুকুম এলো, তখন আমি সেই জনপদগুলোকে উল্টে দিলাম এবং তার ওপর ক্রমাগত পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করলাম।’ (সূরা হুদ- ৮২) আল্লাহ তা’লা এভাবেই তাঁর অবাধ্যতাকারীদেরকে ভয়াবহ গজব দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত করে দিলেন।
‘মাদয়ান’বাসীর কাছে প্রেরিত হলেন হযরত শুয়াইব (আ.)। তিনি তাদের বলেছিলেন, হে আমার জাতি, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই; তোমরা মাপ ও ওজনে কখনো কম করো না। কিন্তু মাদয়ানবাসী শুয়াইব (আ.) এর কথা শুনলো না, জুলুম-অত্যাচার, পাপাচারে লিপ্ত হলো। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ‘মহানাদ’ (ভয়ঙ্কর আওয়াজ) আঘাত হানলো, মুহূর্তেই তাদের ঘরসমূহ উপুড় হয়ে পড়ে রইলো। এমন অবস্থা হলো, যেন সেখানে তারা কখনো কোনো কিছু অর্জন করেনি। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ধ্বংসই ছিলো মাদয়ানবাসীর চূড়ান্ত পরিণাম, ঠিক যেমন পরিণাম হয়েছিলো সামুদের!’ সূরা হুদ- ৯৫
হযরত সালেহ (আ.) যখন তাঁর কওমকে বললেন, হে আমার জাতি, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই, তিনি তোমাদের জমীন থেকেই পয়দা করেছেন, তাতেই তিনি তোমাদের বসবাস করিয়েছেন, অতএব তোমরা তার কাছেই গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তাওবা করে তাঁর দিকেই ফিরে এসো। কিন্তু যখন ‘সামুদ’ জাতি হযরত সালেহ (আ.) এর কথা মানলো না, অবাধ্যতার চরম পর্যায়ে পৌঁছলো। তখন আল্লাহ তা’লা তাদের ‘মহানাদ’ দিয়ে ধ্বংস করে দিলেন।
আরো কত জাতিকে আল্লাহ তা’লা এভাবে তাঁর অবাধ্যতার কারণে আযাব আর গজব দিয়ে হালাক করেছেন। আল-কুরআনে সবিস্তারে এগুলোর বিবরণ রয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আল্লাহ তা’লা কুরআনে এসব ঘটনা উল্লেখ করে মানুষকে সতর্ক করেছেন, যাতে মানুষ পাপচারে নিমজ্জিত না হয়। আল্লাহর আযাব আর গজবে ধ্বংস না হয়।
মানুষ আল্লাহর নেয়ামত ভোগ করে, অথচ তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে কুণ্ঠাবোধ করে। বিপদে পড়লে আল্লাহকে স্মরণ করে, বিপদ কেটে গেলে তাঁকে ভুলে যায়। এক আয়াতে আল্লাহ তা’লা বলেছেন, ‘তোমরা এ ব্যাপারে কি নিশ্চিত হয়ে গেছো যে, তিনি পুনরায় তোমাদেরকে সেখানে নিয়ে যাবেন না এবং তোমাদের অকৃতজ্ঞতার শাস্তিস্বরূপ তিনি অতঃপর প্রচন্ড ঝড় পাঠাবেন না এবং তোমাদের উত্তাল সমুদ্রে ডুবিয়ে দেবেন না! আর এমন অবস্থা দেখা দিলে তোমাদের জন্য সেদিন আমার মোকাবেলায় তোমরা কোনো সাহায্যকারী পাবে না।’ সুরা বনী ইসরাঈল- ৬৯
এই বিশ্বজগতের স্রষ্টা আমাদের প্রতিপালক মহান আল্লাহ তাঁর আপার করুণা ও মহিমায় এই বিশাল পৃথিবীকে আমাদের বসবাসের উপযোগী করে দিয়েছেন, এই মহাশূন্য, গ্রহ-তারা, আকাশের সুবিশাল সামিয়ানা, আলো-বাতাস, আগুন-পানি-মাটি, সাগর-নদী, পশু-পাখি, অসংখ্য নেয়ামতরাজি তিনি মানুষের জীবনোপকরণ হিসেবে দান করেছেন। অন্যসব মাখলুকাতের মধ্যে মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তার পরেও যদি মানুষ আল্লার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়, তাহলে তিনি কেনইবা নারাজ হবেন না? তিনি কি মানুষকে তাঁর অবাধ্যতার জন্য সৃষ্টি করেছেন? রিযিক দান করেছেন? মানুষ আল্লাহর জমিনে বিচরণ করে তাঁর সাথে কুফুরি করবে? তাঁর দেওয়া রিযিক খেয়ে তাঁর সাথে শিরক করবে? তাঁর নাফরমানি করবে? এতো মহা অন্যায়, মহা অপরাধ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আযাব আর গজব থেকে বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে অবশ্যই আল্লাহর একান্ত বাধ্যগত হতে হবে। তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে হবে। তাঁর বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হবে। সকল প্রকার পাপাচার থেকে বেঁচে থাকতে হবে। সর্বদা জান্নাত লাভের তীব্র আকাক্সক্ষা ও জাহান্নামের ভয়ঙ্কর শাস্তির ভয় অন্তরে জাগ্রত থাকতে হবে। বেশি বেশি তাওবা-ইস্তেগফার করতে হবে। আল্লাহ তা’লা আমাদেরকে তাঁর একান্ত বাধ্যগত হওয়ার এবং পাপাচার থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন।
লেখক: শিক্ষক, জামেয়া ইসলামিয়া আনওয়ারে মদিনা মাদরাসা, সিলেট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন