আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে মানবজাতিকে সঠিক পথের সন্ধান এবং তাঁর বিশেষ ক্ষমতা প্রকাশের জন্য অসংখ্য নবী-রাসূলকে মু‘জিযা দিয়ে প্রেরণ করেন। মু‘জিযা একটি আরবি শব্দ। যার অর্থ- অলৌকিক বা বিশেষ ক্ষমতা, অন্য কে অক্ষম করে দেয়া। আল্লাহ তাআলা কেয়ামত পর্যন্ত আগত সমগ্র সৃষ্টিকূলের হিদায়াতের জন্য এবং সকল ক্ষমতার উপর তাঁর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য শেষ নবী মুহাম্মদ সা. এর উপর চিরন্তন মু‘জিযা আল-কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ করেন। যেমনিভাবে মূসা আ. আল্লাহ প্রদত্ত মু‘জিযা লাঠির মাধ্যমে সে সময়ে বিদ্যমান যাদুকরদের সকল যাদুকে পরাভূত করে আল্লাহর একত্ববাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “তিনি বললেন, তোমরাই নিক্ষেপ কর। যখন তারা নিক্ষেপ করল তখন লোকদের চোখগুলোকে ধাঁধাঁর সৃষ্টি করলো এবং তাদেরকে ভীত ও আতংকিত করল, তারা এক বড় রকমের যাদু দেখাল। আমি মূসার নিকট এই প্রত্যাদেশ পাঠালাম, তুমি তোমার লাঠিখানা নিক্ষেপ করা। মূসা তা নিক্ষেপ করলে ওটা(এক বিরাট অজগর হয়ে) সহসা ওদের অলীক সৃষ্টিগুলিকে গ্রাস করতে লাগল। ফলে সত্য প্রতিষ্ঠিত হল এবং তারা যা করেছিল তা বাতিল হয়ে গেল (আল-আরাফ, ১১৬-১১৮)”। ঈসা আ. কে এমন সময় আল্লাহ তাআলা নবী হিসেবে প্রেরণ করেন, যখন সমসাময়িক চিকিৎসা শাস্ত্র প্রভূত অগ্রগতি সাধন করেছিল এবং এ অগ্রগতির জন্য তারা নিজেদের চিকিৎসা শাস্ত্রে শ্রেষ্ঠ দাবী করতো। ঈসা আ. তাঁর প্রদত্ত মু‘জিযার মাধ্যমে জন্মান্ধ, বধির, কুষ্ঠরোগসহ নানা রোগের আরোগ্য করেন, কিন্তু সে সময়ের চিকিৎসা শাস্ত্রের পন্ডিতরা ঐ সকল রোগের চিকিৎসা করতে অপারগ হয়েছিলো। আল্লাহ তাআলা এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন, “যখন আল্লাহ বললেন: হে ঈসা ইবনে মরিয়ম, তোমার প্রতি ও তোমার মাতার প্রতি আমার অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন আমি তোমাকে পবিত্র আত্মার দ্বারা সাহায্য করেছি। তুমি মানুষের সাথে কথা বলতে কোলে থাকাতেও এবং পরিণত বয়সেও এবং যখন আমি তোমাকে গ্রন্থ, প্রগাঢ় জ্ঞান, তাওরাত ও ইঞ্জিল দান করেছিলাম এবং যখন তুমি কাদামাটি দিয়ে পাখীর প্রতিকৃতির মত প্রতিকৃতি নির্মাণ করতে আমার আদেশে, অতঃপর তুমি তাতে ফুঁ দিতে; ফলে আমার আদেশে পাখী হয়ে যেত এবং তুমি আমার আদেশে জন্মান্ধ ও কুষ্টরোগীকে নিরাময় করে দিতে এবং আমারই আদেশে তুমি মৃতদের (কবর থেকে) বের করে আনতে, পরে যখন তুমি তাদের কাছে (নবুওতের) এসব নিদর্শন নিয়ে পৌছালে, তখন তাদের মধ্যে যারা (তোমাকে) অস্বীকার করেছিলো তারা বললো, এ নির্দশনগুলো যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়, তখন আমিই তোমার (কোনো অনিষ্ট সাধন) থেকে বনী ইসরাঈলদের নিবৃত্ত করে রেখেছিলাম” (আল-মায়েদা -১১০)। আল্লাহ তাআলা যখন শেষ নবী মুহাম্মদ সা. কে আরবজাতির নিকট প্রেরণ করেন, তখন তারা আরবী ভাষার চর্চার মাধ্যমে ভাষার দিক দিয়ে উচ্চশিখরে আরোহন করেছিল। তারা বর্তমান যুগের ন্যায় ভাষা চর্চার বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রতিযোগিতা করত এবং বিজয়ীদের বিশেষ সম্মান দিত ও পুরষ্কৃত করত। এ সময় আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ সা. এর প্রতি সর্বোৎকৃষ্ট আরবী সাহিত্যে শেষ আসমানী গ্রন্থ আল-কুরআন নাযিল করেন। আল-কুরআনের এ ভাষাশৈলী দেখে কাফের-মুশরিকরা এর তাৎপর্য অনুধাবন করে সাধারণ মানুষের কাছে অপ-প্রচার চালাতে লাগলো যে মুহাম্মদ সা. যাদুকর, তাই তাঁর কাছে গেলে কুরআনের মাধ্যমে সে মানুষদের মোহগ্রস্ত করে ফেলবে। কিন্তু তারা মানুষের কাছে অপপ্রচার করলেও নিজেরা কুরআনের ভাষার অলংকার, বর্ণনা ভঙ্গি ও বাক্য গঠন প্রণালী অনুধাবন করে চুপি-চুপি রাতের আধারে তা শুনার জন্য রাসূল সা. এর গৃহের আশে-পাশে অবস্থান করত। আবার দিনের বেলায় তারা প্রচার করত যে, কুরআন আমাদের গদ্য-কবিতার ন্যায় কথা-বার্তা, সুতরাং আমরাও কুরআনের মত আয়াত রচনা করতে পারি। তাদের এহেন প্রপাগান্ডার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন, “(আল্লাহ তাআলা বলেন) যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, তাহলে এর মত একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এসো। তোমাদের সেসব সাহায্যকারীদেরকেও সঙ্গে নাও-এক আল্লাহ ছাড়া, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক”(২:২৩)। কাফির-মুশরিকদের আরবী ভাষায় বিশেষ জ্ঞান থাকা সত্তে¡ও আল্লাহর চ্যালেঞ্জের কাছে তারা পরাভূত হয়ে যায়, যা আজ পযর্ন্ত কেউ করতে সক্ষম হয়নি। কুরআন নাযিলের সময় যেমনিভাবে কুরআন সে সময়কার বিশেষ জ্ঞান (আরবী ভাষা) কে পরাভূত করেছিল, ঠিক আজও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখে পরাভূত করেছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত যত জ্ঞান-বিজ্ঞান আসবে সেগুলোকেও কুরআনুল মাজিদ পরাভূত করবে। কেননা আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে সকল জ্ঞানের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। কুরআন নাযিলের পর থেকে বিজ্ঞানীরা এর অনেক তত্তে¡র সাথে দ্বিমত পোষণ করে, কিন্তু পরবর্তীতে তারা অধিকতর গবেষণা করে পবিত্র কুরআনের অনেক তত্তে¡র সত্যতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন “প্রত্যেক (গ্রহ-নক্ষত্র) তার নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমন করছে”(৩৬:৪০)। আল্লাহর এ তত্তে¡র সাথে বিজ্ঞানীরা প্রথমে দ্বিমত পোষন করে। তারা দাবী করে ছিল যে, সকল গ্রহ-নক্ষত্র গতিশীল নয়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে তারা কুরআনের তত্তে¡র কাছে পরাভূত হয়ে স্বীকার করল যে, প্রত্যেক গ্রহ-নক্ষত্রই নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমন করছে। তাইতো বিজ্ঞানী ড. মরিস বুকাইলি পবিত্র কুরআনের সকল বৈজ্ঞানিক তত্ত¡ স্বীকার করে বলেন, “The Quran does not contain a single scientific statement that is unacceptable”. এ গ্রন্থে আল্লাহ তাআলা অতীতের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনার পাশাপাশি সমসাময়িক কালে কাফের-মুশরিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবও দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, আর্ন্তজাতিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিসহ বিজ্ঞানের সকল বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। কিন্তু আফসোসের বিষয়, মুসলিম জাতি আজ এ চিরন্তন মু‘জিযা আল-কুরআনকে পরিত্যাগ করার কারণে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে নিগৃহীত জীবন-যাপন করছে। তারা আল-কুরআনকে আজ দামি শোপিছ হিসেবে সাজিয়ে রাখছে, আবার কেউ অতি ভক্তি-সম্মান করে এমন স্থানে রাখছে যে, তা থেকে উপকার গ্রহণ দায় হয়ে যায়। অথচ আল-কুরআনের প্রথম নিদের্শই হচ্ছে “পড় তোমার প্রভুর নামে”, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তার অনুসারীরা কুরআন না পড়েই তা থেকে উপকার নিতে চায়। আল্লাহ তাআলা কুরআনকে পড়তে, বুঝতে ও তা থেকে উপকার গ্রহণ করতে বলেছেন। তাই মানবজাতির হেদায়াত, জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বার উন্মোচন ও মুসলমানদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য আল-কুরআন অধ্যয়নের মাধ্যমে এর চিরন্তন মু‘জিযার বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন